Category: ভ্রমণ কাহিনী (Page 1 of 2)

  গিউ গ্রামের রহস্যময় মমি

প্রত্যন্ত স্পিতি উপত্যকার কেন্দ্রে হিমাচল প্রদেশের হিমালয় অঞ্চলের উঁচুতে গিউ গ্রামটি অবস্থিত। যদিও এই গ্রামটি তার অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং অনন্য সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত, কিন্তু যা এই গ্রামটিকে সত্যই অন্যদের থেকে আলাদা করেছে তা হল এর রহস্যময় গিউ মমি। এটি একটি সুসংরক্ষিত, শতাব্দী-প্রাচীন মানবদেহ যা ভ্রমণকারীদের এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের একইভাবে মুগ্ধ করেছে৷ লাহুল ও স্পিতিতে অবস্থিত রুক্ষ পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত  গিউ গ্রামটি এই অঞ্চলের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের অন্তরালে তার যে সবচেয়ে বড় আকর্ষণকে রহস্যের আবরণে ঢেকে রেখেছে তা হ’ল এই মমি। তাই লাহুল ও স্পিতিকে বিদায় জানানোর আগে এই অসাধারণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সংঘা তেনজিনের মমি একবার সচক্ষে দেখবনা তা হয়না।

এই সেই স্পিতি উপত্যকা, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, এই চিত্তাকর্ষক পর্বতমালার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে, আধুনিকতার দ্বারা কলুষিত না হয়ে তাদের প্রাচীন সভ্যতার ধন এবং রহস্য যুগযুগ ধরে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত “স্পিতি ভ্যালির গিউ মঠের রহস্যময় মমি” তাই সারা বিশ্বের পর্যটক, শিল্পী, অভিযাত্রী এবং গবেষকদের সমান ভাবে আকর্ষণ করে। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মমিকরণ প্রক্রিয়া সত্যই বিরল।  গিউ মমি ১৯৭৫ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল যখন এই অঞ্চলে একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং পুরানো গিউ মঠটি ভেঙে পড়ে। মঠটি ভেঙে পড়ার সাথে সাথে মন্দিরের নীচে একটি ছোট ভূগর্ভস্থ কক্ষে অবস্থিত এই গিউ মমিটি আত্মপ্রকাশ করে । এই মমিটি ৫০০ বছরেরও আগে এখানে বসবাসকারী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সংঘা তেনজিনের দেহাবশেষ বলে মনে করা হয়। গিউ মমিকে যা বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে তা হ’ল এর সংরক্ষণের অবস্থা। দেহটি উল্লেখযোগ্যভাবে অক্ষত, ত্বক, চুল এবং নখ এখনও দৃশ্যমান। মমির সংরক্ষণ পদ্ধতিগুলি একটি রহস্য হিসাবে রয়ে গেছে কারণ স্পিতি উপত্যকায় ঐতিহ্যবাহী মমিকরণ অনুশীলনের কোনও রেকর্ড নেই। কিছু বিশেষজ্ঞের মত অনুযায়ী এই অঞ্চলের প্রাকৃতিকভাবে শুষ্ক এবং ঠান্ডা জলবায়ু এবং ভূগর্ভস্থ কক্ষে তামা এবং পারদের উপস্থিতি মমির সংরক্ষণে সহায়ক হয়েছে।

মিশরের নীল নদের পশ্চিম তীরে ভ্যালি অফ কিংস এবং কায়রো মিউজিয়ামে আমরা বেশ কয়েকটি মমি দেখেছিলাম, যেগুলোকে রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছিল যাকে বলা হয় মৃতদেহে ক্ষয়-নিবারক দ্রব্য দেওয়া হয়েছিল এবং তারপর কাপড়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সম্পূর্ণ মমিকরণ প্রক্রিয়াটি প্রায় ৭০ দিন সময় নেয় এবং বেশ কয়েকটি পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার সবগুলিরই গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় তাত্পর্য ছিল পাশাপাশি মৃতদেহ পরিচালনার জন্য ব্যবহারিক প্রভাব ছিল।   প্রক্রিয়াটির প্রধান উপাদানগুলি ছিল – পরিষ্কার করা অর্থাৎ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পুরোহিত দ্বারা হৃৎপিণ্ড ব্যতীত অন্য অঙ্গগুলির অপসারণ, ডিহাইড্রেশন যার মাধ্যমে ন্যাট্রন লবণ ব্যবহার করে শরীর শুকানো হয়, অভিষেক অর্থাৎ দেহটি কাপড় ও রজনের স্তরগুলি দ্বারা আবদ্ধ করা হয় এবং মোড়ক যা একটি বিশেষ কৌশল যার দ্বারা মমিটি মোড়ানো হয়। প্রাচীন মিশরীয় মমিগুলি যা বেশিরভাগই আমরা যাদুঘরে দেখে থাকি, সেগুলি বিশেষ ক্ষয়-নিবারক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে এই ব্যয়বহুল সমাধির ব্যবস্থা মূলত রাজপরিবারের সদস্য এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল।  জনসংখ্যার খুব বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে কেবল কবর দেওয়া হত। কাপড় বা মাদুরের কয়েকটি স্তরে ঢেকে বালির মধ্যে অগভীর কবরে স্থাপন করা হত। শরীরের তরল পদার্থগুলো গরম, শুকনো বালি দ্বারা বাষ্পীভূত হয়ে পচনকে প্রতিহত করত, যা ক্ষয়-নিবারক রাসায়নিকদের মতোই একই প্রভাব ফেলতো। এই প্রক্রিয়াটিকে ‘প্রাকৃতিক’ মমিকরণ বলা হয়।

তবে স্পিতি ভ্যালির মমি মিশরীয় মমি থেকে অনেকটাই আলাদা৷ চীনের সাথে ভারতের সীমান্তের কাছে, স্পিতি উপত্যকার গিউ গ্রামের মঠটি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত মমির জন্য বিখ্যাত। পঞ্চদশ শতাব্দীর পুরনো, এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, সংঘা তেনজিনের মমি করা দেহটি বসে ধ্যানের ভঙ্গিতে রয়েছে এবং স্পিতি উপত্যকার ঠান্ডা, শুষ্ক আবহাওয়া এর প্রাকৃতিক সংরক্ষণে অনেকটাই সহায়ক হয়েছে। গিউ গ্রামের মমিটি প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো, যা বর্তমানে মঠের পাশে একটি ছোট ঘরের ভিতরে একটি কাচের বাক্সে রাখা হয়েছে। আমরা স্পিতি উপত্যকায় গিউ মমির দাঁত, চুল এবং হাড়ের সংরক্ষিত ত্বক দেখেছি। গবেষকরা এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে মাত্র ২৪টি এই ধরণের মমির সন্ধান পেয়েছেন। সীমান্ত সুরক্ষার কারণে এবং গিউ গ্রামের দুর্গমতার কারণে, এই মমির অস্তিত্ব বছরের পর বছর গোপন ছিল। স্পিতির নির্জন প্রান্তর অঞ্চলটি কয়েক দশক ধরে পর্যটনের নাগালের বাইরে ছিল এবং এমনকি স্থানীয়রাও ভারতের এই গোপন মমি সম্পর্কে অবগত ছিল না। গিউ গ্রামের এই মমিটি ১৯৭৫ সালের ভূমিকম্পের পরে একটি স্তূপ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল, যখন ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত বাহিনী এই অঞ্চলটি পরিষ্কার করে রাস্তা ও বাঙ্কার তৈরি করছিল। ২০০২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ভারতে এই সিক্রেট মমি নিয়ে গবেষণার জন্য এখানে এসেছিলেন। কার্বন ডেটিংয়ের সাহায্যে তারা দেখতে পান যে “গিউ ভিলেজ মমি” সাংঘা তেনজিন ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে একই বসার ভঙ্গিতে রয়েছে এবং তারা উল্লেখ করেছেন যে এটি প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত এবং দেহ সংরক্ষণের জন্য কিছুই ব্যবহার করা হয় নি। এটা সম্ভব যখন কোনও মৃতদেহ চরম ঠান্ডা, শুষ্ক পরিস্থিতি বা অন্য কোনও পরিবেশগত কারণে পচন ও ক্ষয়কে প্রতিহত করে।   প্রথা অনুসারে, একাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বোধিলাভের প্রক্রিয়ায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা স্বয়ং মমি করার প্রক্রিয়া অনুশীলন করছিলেন। “সোকুশিনবুতসু” শব্দটি স্ব-মমিকরণের জন্য, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অনুশীলনকে বোঝায়।  এই প্রথা অনুযায়ী জীবিত থাকাকালীন অনাহার এবং ধ্যানের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রাচীন প্রথা অনুসারে, সন্ন্যাসীরা গুহার অভ্যন্তরে বসে ধ্যানের সাথে সাথে একটি বিশেষ ডায়েট অনুসরণ করতেন। শরীরে মেদ কমানোর জন্য তারা চর্বিসহ কোনো ধরনের খাবার গ্রহণ করতেন না। সেলফ মমিকরণ প্রক্রিয়াটি গ্রহণ করা হয় তাদের জীবনের শেষের দিকে , যা কয়েক মাস থেকে এক দশক পর্যন্ত  সময় নিতে পারে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন ধ্যান এবং ক্রমাগত উপবাসের মাধ্যমে সন্ন্যাসীরা তাদের দেহকে এমন অবস্থায় নিয়ে আসে যেখানে তাদের মৃত্যুর পরে, কোনও ব্যাকটেরিয়া তাদের দেহে বেঁচে থাকবে না এবং উপত্যকার শু এবং ঠান্ডা আবহাওয়া তাদের প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণ এবং মমি করতে সহায়তা করবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় সফল হয় হাতে গোনা কয়েকজন।

বোস্টনের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ডাঃ হার্বার্ট বেনসন মমির প্রাকৃতিক সংরক্ষণের পিছনে রহস্য  অনুসন্ধান করে দেখেন যে কীভাবে ধ্যান সন্ন্যাসীর দেহকে প্রভাবিত করে। তিনি দেখেছেন যে এমনকি সাধারণ ধ্যানও সন্ন্যাসীর অক্সিজেনের ব্যবহার ৬০% কমিয়ে দিতে পারে। টুমো যোগব্যায়াম অনুশীলনকারী সন্ন্যাসীরা তাদের ত্বকের তাপমাত্রা এতটা কমিয়ে দিতে পারে যে তারা হিমশীতল ঠান্ডায় তাদের চারপাশে জড়ানো ভেজা চাদর শুকিয়ে নিতে পারে।  প্রাচীনকালে, গিউ গ্রামটি তিব্বত থেকে লাদাখ এবং স্পিতি হয়ে জাঁস্কারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথে অবস্থিত ছিল। ফলস্বরূপ, গ্রামটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লোকমুখে চলে আসা লোককাহিনীগুলিকে সমৃদ্ধ করেছিল। স্থানীয়রা গর্ব ও নিষ্ঠার সাথে এই কথা বলে ও লোককাহিনী অনুসারে, তারা বিশ্বাস করে যে গিউয়ের মমি এখনো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের গ্রামের করে আসছে। তাই মমিকে স্থানান্তরিত করলে গ্রামে দুর্ভাগ্য, বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসবে। লোককাহিনী অনুসারে সন্ন্যাসী অর্থাৎ বর্তমানে গিউয়ের মমি গ্রামটিকে বিছের বিপদ থেকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করেন যে বিছের কামড়ে গ্রামের অনেক লোকের মৃত্যুর পরে, সন্ন্যাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার জন্য ধ্যানে বসেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর শিষ্যদের তাঁকে সমাধিস্থ করতে বলেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে সন্ন্যাসীদের আত্মা স্বর্গের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সাথে সাথে নীল আকাশ জুড়ে একটি রামধনু দেখা দিয়েছিল এবং পরবর্তী কালে বিছের  উপদ্রবের অবসান হয়েছিল।

স্বভাবতই গিউ গ্রামের অধিবাসী মমিটিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং তাদের রক্ষকের মতো এটি উপাসনা করে। তারা প্রতিদিন গিউ মঠের মমির কাছে প্রার্থনা করে সেখানে ধূপ এবং মাখনের প্রদীপ জ্বালায়। এই মমি এখানে না থাকলে এই গ্রামটি বিশ্বের কাছে অজানাই থেকে যেত। স্পিতি উপত্যকায় মমির আবিষ্কারের ফলে আরও বেশি ভ্রমণকারীরা এখানে আসেন। প্রতি বছর স্পিতি উপত্যকায় পর্যটন বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্থানীয়দের জন্য হোম স্টে এবং ছোট ছোট ক্যাফে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ আসছে। গিউ মমি কেবল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময় নয়; এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য গভীর সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ধারণ করে। এখানকার গ্রামবাসীরা মমিটিকে অভিভাবক আত্মা হিসাবে শ্রদ্ধা করে এবং বিশ্বাস করা হয় যে এটি গ্রামে আশীর্বাদ ও সুরক্ষা প্রদান করে। রহস্য আর ইতিহাসে মোড়া স্পিতি ভ্যালির এই মমি কালজয়ী আকর্ষণের সাক্ষ্য হয়ে আছে। এটি অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে একটি সেতু হিসাবে দাঁড়িয়ে ভ্রমণকারীদের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিকতার সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ জানায়, আর পর্যটকেরাও এই প্রাচীন আশ্চর্যের সাক্ষী হতে পেরে সমৃদ্ধ হয়।

পৃথিবীর ছাদ থেকে দেখা

স্থান – লাসা

সময়- মে-জুন , ২০১৫  যাত্রীগণ – ভয়েজার্স  ক্লাবের সহযাত্রীগণ

লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত

সাংহাই হচ্ছে সমুদ্র  পৃষ্ঠে আর লাসা  হচ্ছে পৃথিবীর ছাদ –  আমাদের পরিকল্পনা ছিল সাংহাই থেকে লাসা এই দীর্ঘ ৪৩০০ কিলোমিটার যাত্রা পথ আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলপথ যা কিনা কিংহাই-তিব্বত রেলপথ  নামে পরিচিত তাতে পাড়ি দেব। এই দীর্ঘ সময়ে অর্থাৎ প্রায় ৪৮ ঘণ্টায় আমরা ধীরে ধীরে এই অধিক উচ্চতা জনিত সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারব, যার ফলে আমরা লাসা পৌঁছে শারীরিক ভাবে সুস্থই থাকব। আরও একটা ব্যাপার ছিল – যাওয়ার সময় ট্রেনে গেলে কিছু কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন কুনলুন পর্বত শ্রেণী,  গোবি মরুভুমি এসব দিনের আলোতে দেখতে পারতাম। কিন্তু বিধি বাম- ট্রেনে যাবার টিকিট না পাওয়ায় আমরা প্লেনে গিয়ে ট্রেনে ফিরব ঠিক হলো।

Continue reading

রাবণ রাজার দেশে (শ্রীলঙ্কা)

© লেখা ও ছবি – অরূপ দাশগুপ্ত

অরিত্ররা তিন ভাই। অরিত্র ছোট। দাদারা দুজনে পড়াশোনায় তুখোড় হলেও অরিত্র বরাবর একটু অমনোযোগী আর ফাঁকিবাজধরনের।স্কুলে কোনোদিনই খুব একটা ভালো রেজাল্ট করতে পারতো না অরিত্র। সব আশা ত্যাগ করে অরিত্রর আর কিছু হবে না ধরে নিয়ে অরিত্রর বাবা ওকে হায়ারসেকেন্ডারীর পর কম্পিউটার নিয়ে পড়তে বললেন। আশা, যদি পাশ করে অন্তত কোথাও একটা চাকরী পায়।

অরিত্রর কেরিয়ার কিন্তু মোটেই খারাপ হয়নি। সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় বি এস সির পর এম সি এ করে শেষে এম টেক কমপ্লিট করে অরিত্র। প্রথমে বছরখানেক দুএকটা কলেজে পার্টটাইম পড়াবার পর স্লেট কোয়ালিফাই করে এখন উত্তর কলকাতায় একটা কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। মাস তিনেক হলো অরিত্র বিয়েও করেছে।

অরিত্রর বউটি, টোড়ি, ভারী শান্ত! নিজেও স্লেট কোয়ালিফাই করে একটা কলেজে ইতিহাসের ফুলটাইম টিচার। তাসত্বেও সবসময় কেমন একটা সুগৃহিনী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা টোড়ির।

কলেজে ছুটি না পাওয়ায় এখনও অরিত্ররা কোথাও বেড়াতেও যেতে পারেনি। 

Continue reading

বালির বালুকা বেলায়

সময়  মে ২০১৮   যাত্রীগণ – দেবাশিস দাশগুপ্ত ও মনিদীপা দাশগুপ্ত

লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত    

         স্থান – কিন্তামনি, উবুদ, কুটা,  উলুওয়াতু, দেনপাসার, তানা লট

 This is a travelogue in Bengali about Bali, Indonesia. Bali is unique, Bali is unmatched, a magical blend of culture, nature, activities, weather, culinary delights and above all the beautiful people of this island. Bali is rated as one of the best travel destinations in the world by countless websites, review portals, and travel magazines – for very good reasons. Whatever is your age, background, budget or interest, there is something great for everyone to explore and discover in Bali

ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে বালির মানচিত্র
ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে বালির মানচিত্র

গরুড় এয়ারলাইন্সের  ছোট ফ্লাইটে  যোগজাকার্তা থেকে বালির ডেনপাসারে এসে পৌঁছলাম।আকাশ পথে বালির প্রবেশদ্বার নগুরাহ রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। মালপত্র নিয়ে বহির্দ্বার দিয়ে  বেরোতেই দেখলাম আমাদের গাইড ফ্রেডি প্ল্যাকার্ড   নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

Continue reading

সিমলিপাল ভ্রমণের পূর্ব কথা

লেখা- তীর্থ দাশগুপ্ত

জঙ্গল আমার অতি প্রিয় গন্তব্য । অরণ্য প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ স্পর্শ আমাকে ছোটবেলা থেকেই টানে । অনেকের ই টানে , আমার মতন যারা জঙ্গলবিলাসী ও জঙ্গলপ্রেমী । সুযোগ পেলেই তাই ইচ্ছা হয় দুদন্ড প্রকৃতির কোলে কাটিয়ে আসি । নগরজীবনের যাঁতাকলে , নানাবিধ স্ট্রেসের থেকে মুক্তির একটা অন্যতম পথ নিষ্কলুষ প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া । এই অরণ্য প্রীতি অনেকটাই এসেছে বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী বুদ্ধদেব গুহর অগণিত লেখা পড়ে । আমি যে ওনার একনিষ্ঠ ভক্ত এবং আমার মতন অগণিত পাঠক পাঠিকা ,তা এর আগে কয়েকটি লেখায় আমি আগেই বলেছি । শেষ জীবনে ওনার সাথে ফোনালাপ হয় । সেই নিয়মিত আলাপচারিতা করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে দ্বিতীয়বার ভর্তির কয়েকদিন আগে পর্যন্ত চলেছিল ।

মনে আছে একদম প্রথম ফোনেই দাদা বলেছিলেন সিমলিপাল যাবার কথা । দেশ বিদেশের সব অরণ্যের মধ্যে সিমলিপালের মোহিনী রূপের আকর্ষণ সব চেয়ে বেশী ছিল ওনার কাছে এটাও বলেছিলেন । ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যাবার সাহস হয়না বলাতে বলেছিলেন ” বেপাড়ার সুন্দরী মেয়ে কে চুমু খেয়ে এলে সেপাড়ার জোয়ানেরা কি ঠ্যাঙাবে নাকি মালা দেবে ? “
সিমলিপাল হল ভয়ঙ্কর সুন্দরী । এর পর ওনার ই লেখা “অন্য চোখে ” বইতে ” ভয়ঙ্কর সুন্দরী “লেখা পড়ে আরো ধারণা হয় । আস্তে আস্তে খোঁজ নিয়ে দেখি যে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ওখানে এখন অনেকটাই কমেছে । তাই সাহসে ভর করে এই বছরের বর্ষশেষে আমার ও আমার বাল্য বন্ধুর পরিবার চারদিনের সিমলিপাল অরণ্য ভ্রমণের পরিকল্পনা করলাম ।

এই লেখাটি সেই ভ্রমণের পূর্ব কথা ।


জঙ্গল ভ্রমণ ঠিক আর পাঁচটা টুরের মতন নয় ।
1) ফরেস্ট বাংলো তে থাকতে হয় যেখানে সবরকম স্বাচ্ছন্দ্য নেই হোটেলের মতন। বিদ্যুৎ নেই । তাই সন্ধ্যের পর অন্ধকারে বিশেষ কিছু করার থাকেনা . তবে ফরেস্ট বাংলোর ব্যালকনি তে বসে রাতের জঙ্গলের শোভা অনুভব করতে বেশ লাগে । চুপ করে বসে থাকলে কতরকম আওয়াজ শোনা যায় । নানান গন্ধ নাকে আসে । সব মিলিয়ে এই আদিম পরিবেশ যাদের ভালো লাগে, অরণ্য ভ্রমণ তাদের টানবেই এটা বলতে পারি ।
2) সাজগোজের বাহুল্য অরণ্য ভ্রমণে চলেনা । লাল বা উত্তেজক কোনো রঙের পোশাক পরা চলেনা । কারণ জীবজন্তুরা উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে ।সবুজ , মেটে রং বা কোনো হালকা রঙের পোশাক চলে যাতে প্রকৃতির সাথে বেশ মানিয়ে যায় ।
3) বেশী উত্তেজক সেন্ট বা পারফিউম মাখা যায়না । এমন ও শুনেছি খুব কড়া পারফিউম গায়ে মাখাতে মৌমাছিরা ঘিরে ধরে এবং তাদের বিষদংশনে আহত হন কেউ কেউ ।
4) সেলফির পেছনে না ছুটে যতটা সম্ভব প্রকৃতির অনবদ্য শোভা ক্যামেরাবন্দি করতে হয় , বেশিটাই মনের ক্যামেরায় ।
5) পঞ্চয়ন্দ্রিয় কে খুব তীক্ষ্ণ করে চোখ , কান , , নাক সবের অনুভূতি নিয়ে সম্পুর্ন ভালো লাগায় কটাদিন কাটিয়ে আসতে হয় ।
6) নিজেদের মধ্যে বেশী কথা বলতে হয়না । তাতে প্রকৃতি র কথা শোনা যায়না । মানুষের কথাতেই সব চাপা পরে যায় । শহর জীবনে তো শুধুই শব্দ , বেশিটাই অনাবশ্যক । অরণ্য ভ্রমণে যাওয়া তো আসলে নিশব্দতার বাঙময়তা অনুভব করতে ।

তা যারা আমার বক্তব্যের সাথে একমত তাঁরাই পারবেন সম্পুর্ন প্রকৃতিকে অনুধাবন করতে ।
আমাদের কর্তব্য পরবর্তী প্রজন্ম কে মাঝে মাঝেই এই প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত হতে শেখানো ।

সিমলিপাল একসময়ে ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজার hunting ground । দেশ স্বাধীন হওয়ার জাতীয় উদ্যান হয় । দেখা মেলে প্রচুর হাতি , মাউস ডিয়ার , সম্বর , গাউর, স্পটেড ডিয়ার , সজারু , ময়ূর , নানাবিধ পাখী যেমন রাকেট টেইল্ড drongo ইত্যাদি । নামেই টাইগার রিজার্ভ কিন্তু বাঘ কেউ দেখতে পায়না । বিভিন্ন এক্সটিক প্ল্যান্টের সমাহার শুনেছি এই জঙ্গলে । গাইডের থেকে সব চেনার ইচ্ছা রইলো । রয়েছে শাল , আম , জাম , সাহাজ, শিশু , বেল , বিজা বা পিয়াশাল , তেঁতুল । এছাড়া নানারকম লতা , গিলিরি , পুটুস ঝোপ ইত্যাদি। গাছ শুধুই গাছ নয় । তার ও নাম আছে, সৌন্দর্য আছে । এক এক ঋতুতে তার এক এক রকম শোভা আছে ।


বিভিন্ন রকম প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায় । ইচ্ছা রইল সেইগুলা দেখে মুগ্ধ হওয়ার ।
আর আছে প্রচুর ঝর্ণা ও জলপ্রপাত । নামগুলিও ভারী সুন্দর , যেমন জোরান্ডা , বরেহিপানি, উস্কি ইত্যাদি । এই জলপ্রপাত ও সংলগ্ন জঙ্গলের শোভা কিছুটা পায়ে হেঁটেই ঘুরব আমরা । সিমলিপালে পর্যটকরা পায়ে হেঁটে ঘুরতে পারেন , যা এর আগে করবেট ফরেস্টে পারিনি আমরা । জোরান্ডা নামের উৎস ও খুব ইন্টারেস্টিং । কথাটা এসেছে জাউ রান্ধা থেকে । জাউ মানে জিউ । অর্থাৎ অনেক আগে জগন্নাথ দেবের ভোগ মানে অন্ন এখানেই কাছে কোনো গ্রামে নাকি রান্না হত । জোরান্ডা ফরেস্ট বাংলোয় রাতে থাকলে জলপ্রপাতের দিকে নাকি বিচিত্র সব আলো দেখা যায় জ্বলতে নিভতে । শহুরে পরিবেশে এসব অতটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও সভ্যতা থেকে দূরে ওই পরিবেশে এই সব ক্রিয়াকলাপ মনের উপরে যথেষ্ট অভিঘাত ফেলে ।


বরেহিপানি জলপ্রপাতের দৃশ্য নাকি অতুলনীয় । বুড়িবালাম নদী এখন থেকেই নাকি উৎপন্ন হয়েছে ।
আরো সুন্দর সুন্দর জায়গার নাম শুনলাম , যেমন নুয়ানা আর চাহালা । নুয়ানা মানে ন আনা । ময়ূরভঞ্জের রাজা কে ন আনা ট্যাক্স দিতে হত সেই আমলে এখানকার অধিবাসীদের । আবার চাহালা মানে নাকি টলি গেলা । সেই আমলে একবার বিদেশী অতিথি দের নিয়ে রাজা এই চাহালার জঙ্গলে আসেন ও কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনার সাক্ষী হন । অতিথিদের মধ্যে কারুর প্রাণহানিও হয় । চাহালা বাংলোর সামনে একটি বড় পিয়াশাল গাছ আছে । সেটি নাকি কুরুল দিয়ে যেই কাটতে যায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় । এই সমস্ত নানা গল্প এখানে প্রচলিত আছে । লোকালয় থেকে বহু ভিতরে , আদিম বিদ্যুৎ হীন পরিবেশে , রাতের নিঝুম পরিবেশে বাংলোর হাতায় বসে এই সমস্ত গল্প স্থানীয় মানুষজন বা আমাদের গাইডের ( তিনিও স্থানীয় ) মুখে শুনতে বেশ লাগবে আশাকরি ।


স্থানীয় মানুষজন বা আদিবাসীদের বাদ দিয়ে কোনো অরণ্য প্রকৃতিই সম্পূর্ণতা পায়না । ওঁরাও , মুন্ডা ইত্যাদি আদিবাসীদের বাস জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় । এছাড়া আছে বাথুরি সমাজ । এখানকার আদি অধিবাসী । পুজো করে তারা বরামদেও বা জঙ্গলের দেবতার । যেমন সুন্দরবনে দক্ষিণরায় বা বনবিবি । এদের গ্রাম , লোকাচার , গ্জীবনযাত্রা ,ইত্যাদি চাক্ষুষ করার ইচ্ছা রইল । প্রকৃত ভারতবাসী তো এরাই । এতদিন দাদার মানে শ্রী বুদ্ধদেব গুহর লেখা পড়ে মনে মনে এই অপরূপ প্রকৃতির যে ছবি এঁকেছি তা চাক্ষুষ করার সুযোগ হবে এটা ভেবেই আমার উত্তেজনার শেষ নেই । আমার ভ্রমণ সাথীরাও যথেষ্ট excited আশা করি ।


বাকি ভ্রমণ কথা বেড়িয়ে এসেই পরিবেশন করব ।

যবদ্বীপে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির খোঁজে

সময়  এপ্রিল ২০১৮   যাত্রীগণ – দেবাশিস দাশগুপ্ত ও মনিদীপা দাশগুপ্ত

লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত    

                              স্থান – বরোবুদুর ও প্রাম্বানান

                  This is a travelogue in Bengali about Bororbudur and Prambanan, the two World Heritage Sites representing the rich cultural heritage of Java (erstwhile Jabadwip), Indonesia.

Continue reading

পুজোর ছুটিতে তাজপুর

লেখা – তীর্থ দাশগুপ্ত , ছবি – ঋতু দাশগুপ্ত

After a long one and half years break due to lockdown we are ready to indulge in a brief outing. We decided we will visit a weekend spot in this year’s Puja holiday. We didn’t get booking in some remote exotic spot which we initially thought of . Later we booked a beautiful resort in Tajpur . It’s a popular weekend seaside getaway near Digha , west bengal. The resort we stayed at Tajpur is magnificient. In this travelogue our experience in Tajpur will be described briefly in Bengali.

বর্ষা শেষে নীলাকাশে পেঁজা তুলোর মতন মেঘ , আর রাস্তার দুধারে কাশবন । এই দৃশ্য চোখে ভাসলেই মন বলে পুজো এসে গেছে । আপামর বাঙালীর বার্ষিক ভ্রমণের সময়ও এটা । দীর্ঘ করোনা জনিত লোকডাউনের ক্লান্তি কাটাতে বাড়ীর সকলেরই ইচ্ছা কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসি । আর কলকাতার কাছাকাছি আজকাল অসংখ্য সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাবার জায়গা আছে । অনেক চেষ্টা করেও একটু স্বল্পপরিচিত উইকেন্ড স্পটে কোনো বুকিং পেলাম না । দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া হয়ে গেছে । করোনার গ্রাফ ও নিম্নমুখী । এই অবস্থায় বোধকরি জনগণ আর ঘরের চার দেওয়ালে বন্দী থাকতে চাইছে না ।
শেষ মেশ দীঘার কাছে তাজপুরে একটা ভারী সুন্দর রিসোর্টে থাকার ব্যবস্থা করলাম ।

Continue reading

লাদাখের তুরতুক গ্রাম

স্থান – লাদাখ

সময়- আগস্ট, ২০১৬  যাত্রীগণ – ওয়ান্ডারভোগেল ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর সহযাত্রীগণ

লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত

লাদাখের মানচিত্র

লাদাখের এক প্রত্যন্ত প্রান্তে অবস্থিত এক ছোট্ট জনপদ তুরতুক। এখান থেকে পাকিস্থান সীমান্তের দূরত্ব মেরেকেটে ৮-১০ কিলোমিটার হবে। নিয়ন্ত্রণ রেখার এপারে এটাই শেষ ভারতীয় জনপদ।

Continue reading

অশান্ত বলকান

সময়-  জুন-জুলাই ২০০৬   যাত্রীগণ – দেবাশিস দাশগুপ্ত ও অফিসের সহকর্মীরা

লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত    

  স্থান – সারায়েভো, জেনিচা, ত্রাভনিক, মোস্তার ও ভিসোকো

শেষ পর্ব

আমাদের প্রথম যাত্রা রাজধানী সারায়েভো। সারায়েভোর ইতিহাস বহু প্রাচীন – আগেই বলেছি। প্রথম মহাযুদ্ধের যে দাবানল সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল তার  স্ফুলিঙ্গ ছিল এই সারায়েভো। বসনিয়ার জনগন তখন অস্ট্রিয়ার শাসনে অসন্তুষ্ট ও  বিক্ষুব্ধ হয়ে  সার্বিয়ার সঙ্গে সংযুক্তিকরণ চাইছিল। সার্বিয়ার সৈন্য বাহিনীর চক্রান্তে ২৮শে জুন, ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে অস্ট্রো-হাঙ্গারীয় সাম্রাজ্যের ভাবী উত্তরাধিকারী  প্রিন্স ফার্দিনান্দ ও প্রিন্সেস সোফিয়া আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারাল এই সারায়েভোতেই। এই ঘটনা থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের  সূত্রপাত। মিলজাস্কা নদীর ওপরে যে সাঁকোর কাছে এই ঘটনা ঘটেছিল তার নাম ফার্দিনান্দ ব্রিজ। সেই ব্রিজের উপরে এক পাথরের ফলকে লেখা বিবরণ থেকে এই ঘটনা জানতে পারলাম।

Continue reading

অশান্ত বলকান

সময়-  জুন-জুলাই ২০০৬   যাত্রীগণ – দেবাশিস দাশগুপ্ত ও অফিসের সহকর্মীরা

লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত    

স্থান – সারায়েভো, জেনিচা, ত্রাভনিক, মোস্তার ও ভিসোকো

প্রথম পর্ব

  দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে প্রায় ৮ বছর বাদে আবার কর্মোপলক্ষ্যে পা রাখলাম পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ার একটা প্রদেশে যার বর্তমান নাম বসনিয়া- হার্জেগোবিনা । ২০০৬ সালে দাঁড়িয়ে বোঝা সম্ভব নয় যে নব্বইর দশকে এ দেশ ছিল গৃহযুদ্ধে জর্জরিত – ত্রাসের রাজত্ব। অবশ্য আজকে সে কথা অপ্রাসঙ্গিক। সেই গৃহযুদ্ধের স্মৃতি এখন অনেকটাই ম্লান, মনের ক্ষতর ওপরে পড়েছে সময়ের প্রলেপ। এয়ারপোর্টের থেকে আসার পথে গতবার রাস্তার পাশের বাড়ী গুলি দেখেছিলাম বুলেটের ক্ষত আর গ্রেনেডের ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এখন সেখানে ঝাঁ চকচকে মার্কেটিং কমপ্লেক্স। লোকের মনে যুদ্ধ পরবর্তী বিহ্বলতা এবং অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে, যদিও দারিদ্র্য এবং বেকারি এখনও অনেকটাই প্রকট এবং দেশের অর্থনীতির অবস্থা বেশ টালমাটাল।

বিগত নব্বইয়ের দশকে খবরের কাগজে এবং টিভির পর্দায় এই দেশের নাম প্রায়ই উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে। ধর্ম ও জাতি বিদ্বেষ যে কোটি কোটি প্রাণ ছিনিয়ে নিয়েছে  আরব-ইজরায়েল, ভারত-পাকিস্তান এইসব দেশে  বসনিয়ার ঘটনা তারই একটি সংযোজন। সেই জাতি বিদ্বেষের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে  তখন বসনিয়া, কসোভো, আলবেনিয়া, মন্টিনিগ্রো – অশান্ত বলকান অঞ্চলের এই নাম গুলি ছিল মিডিয়ার কল্যাণে  বহুশ্রুত। বলকান অঞ্চলের অতীতও কম ঘটনা বহুল নয়। এখানকার  মাটিতে কান পাতলে শোনা যাবে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ এবং হাওয়ায় ভেসে আসবে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেই চতুর্দশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী – ৭০০ বছরের সুদীর্ঘ  ইতিহাস, যার পাতায় পাতায় অনেক অজানা কাহিনী লেখা আছে বহির্বিশ্বের  মানুষ যার খবর রাখেনা। এই দেশের উপর কে আঘাত হানে নি? অতীতে এই দেশ বাইজান্টাইন, অটোম্যান ও অস্ট্রো-হাঙ্গারীয় সাম্রাজ্যের দখলে ছিল এবং সাম্প্রতিক কালে সহ্য করতে হয়েছে সার্ব ও  ক্রোয়েটদের আঘাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বসনিয়া অঞ্চল অস্ট্রো-হাঙ্গারীয় সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সার্বিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ এপ্রিল সারায়েভো একটি সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য দ্বারা অবরুদ্ধ হয়েছিল যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রু-অধিকৃত পূর্ব ইউরোপের যুগোস্লাভিয়ায় সংগ্রামরত ছিল । যুদ্ধের শেষে ফেডারেল পিপলস রিপাবলিক অফ যুগোস্লাভিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৪৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নতুন দেশের ছয়টি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়।যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা একটি অনন্য সংঘবদ্ধ রাজ্য ছিল যার প্রভাবশালী কোন জাতিগত গোষ্ঠী ছিল না।

 কিন্তু রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে কম্যুনিস্টদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অনেক দেশের মত বসনিয়াও তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সেই জন্মলগ্ন থেকেই সার্ব, ক্রোয়েট এবং মুসলিমদের মধ্যে জাতি বিদ্বেষের আগুন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যদিও এখানকার লোকেদের কাছে শোনা যে আগে ধর্ম নিয়ে এদেশে কোন বিরোধ ছিলনা। এদেশের জনসাধারণের মধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম এবং বাকীরা অর্থাৎ সার্বরা অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান এবং ক্রোয়েটরা রোমান ক্যাথলিক।

১৯৯১ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার অঞ্চলগুলিতে সার্ব জনগোষ্ঠী স্বঘোষিত সার্ব স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করেছিল। পরে প্রমাণিত হয় যে সার্বিয়ার যুগোস্লাভ পিপলস আর্মি বেলগ্রেড থেকে বোসনিয়াক সার্বদের গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করছিল। ১৯৯২  সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় কমিউনিটি বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্বাধীনতা স্বীকৃতি দিলে বসনিয়ার সার্ব আধাসামরিক বাহিনী সারায়েভোর উপর গুলি চালানো শুরু করে এবং যুগোস্লাভ সেনাবাহিনীর সহায়তায় বসনিয়ার সার্ব ইউনিটগুলি এই শহরটিতে আর্টিলারি বোমা হামলা শুরু করে। পূর্ব বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনার অনেকগুলি শহরে স্থানীয় বোসনিয়াক জনসংখ্যার বেশিরভাগকে বহিষ্কার করা হয়েছিল জাতিগত নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়াটি কার্যকারী করার জন্য। যদিও বোসনিয়াকরা এর শিকার এবং সার্বরা প্রাথমিকভাবে অপরাধী ছিল, কিন্তু এই অপরাধীদের মধ্যে ক্রোয়েটরাও ছিল। এদিকে আমেরিকা এই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বাড়াতে ক্রোয়েট এবং মুসলিমদের পেছনে দাঁড়াল। এই সুযোগে পোয়াবারো হয়েছিল অস্ত্র ব্যবসায়ীদের। একদিকে ইরান, তুরস্ক এবং অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং অপর দিকে রাশিয়া অস্ত্র প্রতিযোগীতায় নেমে পড়ল। রাজায় রাজায় যুদ্ধ চলল – উলুখাগড়ার প্রাণ গেল। সীমান্তের ওপার থেকে আসা অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত হয়ে মধ্য-বসনিয়ার মুসলিম বাহিনী এবারে সার্ব দের উপরে আঘাত হানল। আমেরিকা এবং ক্রোয়েটদের সম্মিলিত শক্তি সারায়েভো থেকে সার্বদের বিতাড়িত করল। প্রায় দুই লক্ষ সার্ব বাহিনী যারা প্রায় দীর্ঘ তিন বছর ধরে আক্ষরিক অর্থে সারায়েভোকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল বাইরের বিশ্ব থেকে, তারা অবশেষে দেশ ছাড়ল – সারায়েভো হল মুক্ত।

 বসনিয়া স্বাধীন হবার পর যুদ্ধোত্তর এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৫ সালে। তার ফলে ক্রোয়েট, মুসলিম ও সার্বদের কোয়ালিশন সরকার দেশ শাসন করবে বলে ঠিক হয়। এই চুক্তি তৎকালীন ইউরোপীয় কমিউনিটি এবং ন্যাটোর যৌথ উদ্যোগে সম্পাদিত হয়।কিন্তু ততদিনে কয়েক লক্ষ লোক গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে, প্রায় কুড়ি লক্ষ লোক হয়েছে উদ্বাস্তু এবং বহু লোকের কোনও খোঁজই পাওয়া যায়নি।

#4 Sarajevo- the mass burial ground of war victims

 রাজনীতিবিদদের দাবার চালে সবার আগে তো বোড়েরাই সাবাড় হবে এবং সব শেষে  সকৌশলে  কিস্তিমাত। ইতিহাস বোধ হয় বারে বারে এই ভাবেই ফিরে আসে। আমরাও তো একই চক্রান্তের শিকার হয়েছি। আমাদেরও এই ভাবে খেসারত দিতে হয়েছিল এবং এখনও দিতে হচ্ছে। ধর্মীয় এবং বিভেদকামী  শক্তিগুলি এবং সন্ত্রাসবাদীদের রোষের বলি হচ্ছে সাধারণ অসহায় নাগরিকেরা।

এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি। আমাদের গন্তব্যস্থল রাজধানী শহর সারায়েভো থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে শিল্পনগরী জেনিচা। শহর ছাড়াতেই চোখে পড়ল পথের দুপাশে সবুজ প্রান্তর – পপলার, বার্চ আর ওকগাছগুলি সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে, মাঝে মাঝে দেখা যায় গ্রাম্য কুটির, ফুলের বাগান আর চোখে পড়ে আপেল, নাসপাতির বাগান আর স্ট্রবেরীর ঝোপ।কিছু দূর যাবার পর চোখে পড়ল শিল্পনগরীর বসতি,  গাড়ীটা বাঁক ঘুরতেই দেখা পেলাম নুড়ি বিছানো বসনা নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। 

#4 Bosna  River Zenica

গত বারের আর এবারের আসার মধ্যে এই  দীর্ঘ সময়ে অনেক জল বয়ে গেছে এই নদী দিয়ে  অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে। কিন্তু যা দেখছি তাতে শহরের বিরাট কোনও পরিবর্তন দেখলাম না। শুধু চোখে পড়ল না UN লেখা বড় বড় সাদা গাড়ী গুলি এবং হোটেলের লবিতে বা  অন্যত্র স্টেনগান হাতে ইটালিয়ান এবং তুর্কী সেনারা।

পরের দিন কর্মস্থলে গেলাম। পুরনো অনেকের সাথে দেখা এবং শুভেচ্ছা বিনিময় হলো।  গতবারে যে ছেলেটি আমাদের সাথে দোভাষীর কাজ করেছিলো সে ছিল ভালো ফুটবল প্লেয়ার। তার কাছে শুনেছিলাম গৃহযুদ্ধের সময় শহর যখন অবরূদ্ধ ছিল তখনকার অবর্ণনীয় কষ্টকর দিনযাপনের কাহিনী। বরফের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে দূর থেকে নিয়ে আসতে হত রিলিফের খাদ্য সামগ্রী। এবারে যে ছেলেটি আমার সাথে দোভাষীর কাজ করবে সে বয়সে তরুন এবং স্বভাবেও বেশ শান্ত। পরে ওর সম্বন্ধে আরো অনেক কিছু জানলাম – ও ভারতেও কিছু সময় ছিলো এক আশ্রমে। সেই প্রসঙ্গে পরে আসবো। প্ল্যান্টের মধ্যে কিছু অংশ যা গতবার দেখেছিলাম বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়ে গেছে তার কিছু ভগ্নাবশেষ এখনো বর্তমান – বাকীটা আর্ক ফার্নেসে স্ক্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার হয়ে গেছে। মেশিন শপ আর ফোর্জ শপ যা যুদ্ধের সময় এন্টি-এয়ারক্রাফ্ট গানের ব্যারেল  তৈরি করতে ব্যস্ত থাকত সেখানে আবার কারখানার  বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে আবার সবাই যে যার কাজে লেগে পড়েছে।

যে কোন দেশকে জানার সবচেয়ে ভালো উপায় সেখানকার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সেদেশটাকে দেখা, সেখানকার জনগণের সঙ্গে মিশে তাদের কথা জানা এবং তাদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্যক ভাবে পরিচিত হওয়া। এই উদ্দেশ্যে আমরা কাজের শেষে সপ্তাহান্তে বেড়িয়ে পড়তাম বিভিন্ন শহরে। কখনো রাজধানী সারায়েভো, কখনো মধ্য বসনিয়ার ত্রাভনিক বা দক্ষিণে মোস্তার।

« Older posts