লেখা – তীর্থ দাশগুপ্ত ছবি – ঋতু দাশগুপ্ত , অলঙ্করণে- কৌশিক চক্রবর্তী
লোকতক লেকের অনবদ্য প্রাকৃতিক পরিবেশে মোহাবিষ্ট হয়ে চললাম ভারত মায়ানমারের সীমান্ত শহর মোরে তে । সেখানে এক রাত থাকব আমরা । সেখান থেকেই মায়ানমারের সীমান্ত শহর তামু তে এক বেলা ঘুরব ।
তেমন ই পরিকল্পনা হল । এবারের মণিপুর সফরে এসে গাইড রাজুর কল্যানে এখানকার ইতিহাস , সমাজব্যবস্থা , সংস্কৃতি , ভূপ্রকৃতি ইত্যাদি সম্মন্ধে নানাবিধ জ্ঞান লাভ হয়েই চলেছে । যখন ই গাড়ীতে একজায়গা থেকে অন্য জায়গা সফর করছি তখন ই রাজুর ধারাবিবরণী কানে ঢুকেই চলেছে আর দুপাশের অনবদ্য দৃশ্যপট সিনেমার মতন পরিবর্তিত হয়েই চলেছে । পুরো বিষয়টি টুকরো টুকরো কোলাজের মতন মনের ভিতর ছাপ ফেলে গেছে । আমাদের দেশ ভারতবর্ষের প্রতিটা রাজ্য তার শিল্প সংস্কৃতি মনুষ্যবৈচিত্ৰ ইত্যাদি তে স্বকীয় । মণিপুর রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয় । আরেকটা বিষয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে মনে হয়েছে প্রতিটা রাজ্যের মধ্যেই যেন আস্ত একটা ভারত লুকিয়ে আছে । এই কদিন মণিপুরের রাজধানী শহর ইমফল আর লোকতক লেক অঞ্চল ঘুরে মানুষজন দেখে সর্বোপরি রাজুর জ্ঞানে সম্পৃক্ত হয়ে এই ধারণা মজবুত হয়েছে আরো । এই যেমন মৈতেই অধিবাসীর কথাই ধরুন । আদিকাল থেকে নয় প্রকারের মৈতেই গোষ্ঠীর বসবাস ছিল এখানে , পরে মিলে গিয়ে সাত প্রকার গোষ্ঠী হয় । এক এক গোষ্ঠীর এক এক রকম উপভাষা , এক এক রকম আরাধ্য দেবতা । প্রাচীন মৈতেই সম্প্রদায় উপাসনা করতেন প্রকৃতির । তা সে গাছ ই হোক বা পাথর বা আকাশ । দুপাশের বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত দেখতে দেখতে চলেছি । দিগন্তে পাহাড় । গাড়ীতে স্থানীয় মণিপুরী লোকসংগীত চলছে , হালকা ঠান্ডা একটা হাওয়া মুখ চোখে লাগছে । আমার মেয়ে ওর মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে , আর এই অপরূপ দৃশ্য , গন্ধ , শব্দের ত্রহ্যস্পর্শে উদাসী মন হারিয়ে গেলো সেই প্রাচীন মণিপুরে । কত কথাই মনে আসছিল , মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম কেমন দেখতে ছিল সেই সময়ের সমাজ , গ্রাম কিংবা শহর । পাশেই এই বাংলার মানুষ কতটুকুই বা জানত মৈতেই সমাজ কে । আম নাগরিকদের মধ্যে এতো দূরদেশে ভ্রমণের চল ছিলনা । ভ্রমণ বলতে তো তখন তীর্থে যাওয়া , কাশী , গয়া বৃন্দাবন কিংবা পুরী । আজ আমরা উত্তর পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের কোনে কোনে এই সমস্ত জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছি , যা সেই আমলে ছিল অকল্পনীয় । অবশ্য এই আমলেই বা কজন ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে মণিপুর কে বেছে নেন । আমাদের কিন্তু মনে বেশ একটা আবেশ এসে গেছে টের পাচ্ছি । শুধুই নির্দিষ্ট কিছু স্পট টিক মারা ট্যুরের মতন না ঘুরে এ যেন বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেশ দেখা হচ্ছে । বেশ বুঝতে পারছি এর অভিঘাত দীর্ঘদিন চলবে । হটাৎ চিন্তার জাল ছিঁড়ে রাজুর ধারাবিবরণী পুনরায় চালু । জানেন কি
” সানামাহিজম হল মৈতেই ধর্ম যা কঙ্গেলি ধর্ম নামেও পরিচিত, এটি মৈতেই অধিবাসীদের পূর্বপুরুষদের উপাসনা বা ধর্মীয় ট্র্যাডিশন । এই শব্দটি সানামাহী থেকে উদ্ভূত হয়েছে যার মানে ” সর্বত্র তরলের মতো ছড়িয়ে পড়া” । সানামাহিজম অগ্নি, জল এবং পাহাড়ের মতো প্রকৃতির উপাদানগুলির উপাসনা করে এবং ইম্ফলের পূর্বে আন্দ্রোর লোই গ্রামে এই ট্র্যাডিশন অনুসারে পূজা অনুষ্ঠান করে। সানামাহির পাশাপাশি, অতীতে, “সানামাহী কাচিন ” নামে মৈতেই বাড়ির মধ্যে উপাসনা স্থান লিমারেল সিদবি এবং ফুঙ্গার নামক দেবতার জন্য উত্সর্গ করা হত। এটি আধুনিক মৈতেই পরিবারগুলিতেও দেখা যায় যারা সানামাহিজমের সাথে এখনো যুক্ত ” । বললেন রাজু । মনে মনে ভাবলাম কত উদার এই দর্শণ । তাহলে কি সমাজ যত আধুনিক হয়েছে ততই কি তার দর্শণ , তার ধর্মের উদারতা ক্রমশঃ হ্রাস পেয়েছে ? কে জানে , হবে হয়তো । এই সমস্ত ভাবনাচিন্তা করতে করতেই চলে এলাম কাকচিং । কাকচিং মণিপুর রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের একটি শহর। এটি কাকচিং জেলার সদর দফতর এবং রাজ্যের একটি প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র । 2018 সালে, কাকচিং কে উত্তর পূর্ব ভারতের সবচেয়ে পরিষ্কার শহর হিসাবে ঘোষণা করা হয় । আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল কাকচিঙে সমগ্র মণিপুরের মধ্যে সাক্ষরতার হার সব চেয়ে বেশী । কাকচিং শহরের ভিতর দিয়ে আমাদের স্করপিও এগিয়ে চললো বার্মা সুগনু রোড ধরে সোজা মোরের দিকে । গাড়ী এরপরেই সোজা পাহাড়ে চড়তে লাগলো । পাহাড়ী পথ ধরে এঁকে বেঁকে গাড়ী এগোতে লাগলো মোরের দিকে । দুপাশের দৃশ্য অসাধারণ । কিছু জায়গায় ধাপ চাষ হচ্ছে । ধান, গম, আলু , সর্ষে , কমলালেবু ইত্যাদির । আবার মাঝে মাঝে বিস্তীর্ণ অংশ পাহাড়ী জঙ্গল । ঘর বাড়ী খুব কম । চালক ইরফান গাড়ীর এসি অফ করে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল । দূষণমুক্ত পরিবেশের হালকা ঠান্ডা বাতাস আমাদের মুখ চোখে ছুঁয়ে যেতে লাগলো । সুন্দর একটা বুনো গন্ধ নাকে আসছিল , বোধহয় কোনো পাহাড়ী ফুলের হবে । গাড়ীর স্টিরিওতে একটা মনিপুরী লোকসংগীত বাজছিলো , একটা ঘোর লেগে গেছিলো আমার । ঘোরটা ভাঙলো যখন হটাৎ গাড়ীটা মূল রাস্তা ছেড়ে একটা উঁচু ঢালু পথ বেয়ে উঠে এলো অনেকটা ফাঁকা জায়গায় একটা ওপেন এয়ার রেস্টুরেন্টের সামনে , নাম “গ্যাবি স ক্যাফে ” ।
এই অঞ্চলের নাম টেংনুপল । টেংনুপল শহর আবার নবগঠিত টেংনুপল জেলার সদর ও বটে । টেংনুপল কথাটার মানে হল ক্যাকটাসের বেড়া । টেং মানে হল ক্যাকটাস আর পাল মানে হল বেড়া । ষোড়শ শতাব্দী তে মণিপুর বার্মা যুদ্ধের সময়ে কুকি উপজাতি প্রধান এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ ক্যাকটাসের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেন এই পার্বত্য প্রদেশে যাতে বার্মিজ সৈন্যরা ইমফল পর্যন্ত এগিয়ে যেতে না পারেন । সেই থেকে এই নাম চলে আসছে । অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাক্ষী বার্মা সীমান্তের নিকটবর্তী এই অঞ্চল ।
গ্যাবিস ক্যাফে রেস্টুরেন্টে এসে মন টা ভরে গেল , সুন্দর খোলামেলা জায়গায় উপরে ঢাকা চারিদিক খোলা কাঠের ডিজাইন করা বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বসার জায়গা আর কাঠের টেবিল । একটু পাশেই অবশ্য চারিদিক ঢাকা সাজানো গোছানো রেস্টুরেন্ট ঘর, ঠান্ডার আধিক্য থাকাতে আমরা সেখানেই গিয়ে বসলাম লাঞ্চ সারার জন্যে । রেস্টুরেন্টের বেশীরভাগ কর্মী ই মহিলা । সদা হাস্যমুখে পরিবেশন করে যাচ্ছেন তারা । ঝটপট ফ্রায়েড রাইস ও মাঞ্চুরিয়ান চিকেন সহযোগে লাঞ্চ সেরেই উঠে বসলাম স্করপিওতে । জানালা দিয়ে দূরে বার্মিজ মুলুকের বিস্তীর্ন সমতলভূমি দেখা যাচ্ছিল । এবারে পথ ক্রমশঃ ঘুরে ঘুরে নীচে সমতলে নামছিল । খানিক বাদেই এলো টেংনুপালের আন্তর্জাতিক চেক পোস্ট । বেশ খানিক্ষন সেখানে চেকিং হলো , তারপরেই আবার গাড়ী ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে বার্মার সমতলের দিকে এগোতে লাগলো , লক্ষ্য করলাম মানুষজনের বেশভূষা ও ক্রমশঃ পাল্টাতে লাগলো । এখানে মহিলারা দেখলাম লুঙ্গির মতন করে কাপড় জড়িয়েছে আর উর্ধাঙ্গে জামা , মাথায় অনেকের ফেটি বাধা , গালে সাদাটে রং গোল করে লাগানো , অনেকটা রুজের মতন । শুনলাম মায়ানমারে এগুলোকে থানাকা বলে । মহিলারা রূপচর্চার জন্যে এগুলো ব্যবহার করেন । বুঝলাম একেবারে বার্মা সীমান্তের লাগোয়া হওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষজনের উপর এই প্রতিবেশী দেশের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে । যেতে যেতে একটা মোপেডের মতন দেখতে সরু কতগুলো মোটরসাইকেল দেখিয়ে রাজু বললো ” জানেন , এই বাইকগুলো সব মায়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে আসে, তেল ও কম লাগে চলতে , গ্রামের দিকে যাতায়াতের পক্ষে এগুলি বেশ লাভজনক ” । আমার কৌতূহলী প্রশ্ন , ” তা নম্বর প্লেট ছাড়া এই বাইকগুলি পুলিশে ধরেনা ? ” ” কে ধরবে বলুন ? মফস্বল বা গ্রামে কে ধরবে ? ” বলে রাজু । মনে মনে ভাবি এতো ঢাকঢোল পিটিয়ে এতো চেকপোস্টের আয়োজন করে কি লাভ ? ঘুরপথে চোরাচালানে পণ্যদ্রব্য ঠিক ই ঢুকে যাচ্ছে । বুঝতে পারলাম সমস্ত সীমান্ত শহরের ই বৈশিষ্ট ই বোধহয় এরকম ই । প্রচুর টাকাপয়সার লেনদেন চলে এই সমান্তরাল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে যার এক কণা রাজস্বও ও সরকারের কোষাগারে জমা পড়েনা । এই সব ভাবতে ভাবতেই মূল মোড়ে শহরে প্রবেশ করলাম আর চলে এলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেলে , হোটেল ইলোরা e। এখানেই আজ রাত্রিবাস । প্রথম দর্শনে হোটেলটার মধ্যে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট পেলাম না । শহরের মধ্যে একটা স্ট্যান্ডার্ড হোটেল , যা এই সীমান্ত শহরের ব্যবসায়িক প্রয়োজনের চাহিদা পূরণ করে । সেরকম একটা পর্যটকের সমাগম দেখলাম না । মনে হল হোটেলে যারা উঠেছেন তারা বেশীরভাগ ই ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এসেছেন । কারুকে দেখে মনে হল তারা সপরিবারে এসেছেন , হয়তবা তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন বার্মা মুলুকে থাকেন , অথবা মোড়ের পাশেই মায়ানমারের তামু শহরের প্যাগোডা দর্শনে যাবেন , যেমন যাবো আমরা , ভিসা ছাড়াই । এ এক দারুন ব্যবস্থা , আগামীকাল আমাদের ও বিদেশ দর্শন হবে একবেলার জন্যে ভিসা ছাড়াই ।
দীর্ঘ পথযাত্রার ক্লান্তিতে ঘরে চেকইন করেই চোখ একটু বুজে এলো। ঘুম ভাঙলো ঘরে রুম সার্ভিসের কলিং বেলে । ভাত ডাল তরকারি ফিশ কারির সাদামাটা কিন্তু সুস্বাদু ডিনার সারা হল ।আর তারপরেই টানা ঘুম ।
সকালে ঘুম ভাঙলো নানারকম পাখির ডাকে । ইমফালের তুলনায় এখানে ভোর হয় আগে , অনেকটা পূর্ব দিকে হওয়ার দরুন । জানালা দিয়ে দেখলাম আস্তে আস্তে শহরটার ঘুম যেন ভাঙছে , একদম নিঃশব্দ পরিবেশ । তাড়াতাড়ি প্রাতঃকৃত্য ও স্নানপর্ব সেরে আমরা তিনজনেই একতলায় ডাইনিং রুমে নেমে এলাম । দেখলাম স্থানীয় মানুষজনের কলকাকলিতে জায়গাটা মুখরিত । ঝটপট বুফে ব্রেকফাস্ট সেরেই গাড়ীতে উঠে বসলাম , সদাহাস্যময় রাজু আর ইরফান আমাদের নিয়ে চললো ভারত মায়ানমার আন্তর্জাতিক সীমানায় ।
রাজু বললো ” ভারতীয় নাগরিকগন যেকোনো সচিত্র পরিচয়পত্র যেমন ভোটার আইডি কার্ড কিংবা আধার কার্ড জমা রেখে কেবলমাত্র তামু শহরের মধ্যেই সারাদিনের মতন ঘুরতে পারেন । পরিচয়পত্র মায়ানমার অভিবাসন দপ্তরে জমা রেখে ২০ টাকা দিয়ে একটা টিকিট নিয়ে ভারতীয়রা ঘুরতে পারেন । কিন্তু গেট বন্ধ হয়ে যায় বিকেল ৪ টে তে । তার আগেই আবার ওই টিকিট দেখিয়ে অরিজিনাল আইডি কার্ড ফেরত নিয়ে মোড়ে শহরে ফিরে আস্তে হবে । “
আমি বেশ উৎসাহিত হয়ে বললাম ” বাহ বেশ দারুন তো , ভিসা ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণ । হলেও বা একবেলার জন্যে , তাই বা কম কিসে । “ মূল আন্তর্জাতিক গেট এর অনেকটা আগেই একটা পার্কিং লট এ গাড়ী দাঁড় করালো ইরফান । গাড়ী থেকে নেমে রাজু আমাদের তিনজনকে নিয়ে চললো গেট নম্বর ২ এ । ইন্দো মায়ানমার ফ্রেন্ডশিপ গেট । সামনে ছবি তোলার অনুমতি নেই তাই অনেকটা দূর থেকে একটু ছবি তুললাম । এরপরে রাজুই ওর নিজের আর আমাদের আইডি জমা দেওয়ার সরকারী কাজ গুলি করতে লাগলেন । আমি ততক্ষন এখানকার মানুষজন দের দেখতে লাগলাম । দেখলাম অত্যন্ত ব্যস্ত এই ফ্রেন্ডশিপ গেট । বহু মানুষের আনাগোনা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে , বাণিজ্যিক লেনদেনে । তারমধ্যে যেমন খুব ছোট ব্যবসায়ীরাও আছে তেমন বড় বড় বাক্স দেখে আন্দাজ করলাম যে বড় ব্যবসায়ী রা ও আছেন । খুব ই ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনের কেন্দ্র এই গেট ।
একটু বাদেই দেখলাম রাজুবাবু এক মুখ হাসি নিয়ে কয়েকটা টিকিট হাতে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন । ” চলিয়ে জি , হামলোগো কা পারমিট হো গায়া , অভি উস তরফ থোড়া পায়দল চলকে এক অটো রিজার্ভ করনা হয় , উসি অটো মে হামলোগ তামু শাহর ঘুমেঙ্গে ” ।
মনে মনে বেশ উত্তেজনা হলো , গেট পেরিয়েই তামু শহরে ঢুকেই দেখলাম হটাৎ করে পট পরিবর্তন হয়ে গেলো, ঘরবাড়ী গুলো একটু অন্যরকম , বেশিরভাগ ছোট ছোট এক তলা কিংবা বড়জোর দোতলা । মানুষজন ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে , স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে লুঙ্গি র মতন এক প্রকার পোশাক লক্ষ্য করলাম, মহিলাদের প্রায় প্রত্যেকের ই গালে তানখা । এক ঝলক দেখে বেশ বোঝা যায় দেশ টা গরীব । মোরের তুলনায় রাস্তায় নিজস্ব গাড়ীর সংখ্যা কম , যাও বা কিছু চলছে চেহারায় জৌলুস কম । রাস্তার পাশে বেশ কিছু অটো দাঁড়িয়ে আছে । আমাদের এখানকার অটোর তুলনায় অনেকটা বড় এখানকার অটোগুলো । রাজু এগিয়ে গিয়ে একটি অটো র চালকের সাথে দরদাম করে সেটাই নির্ধারণ করলেন আমাদের এই এক বেলা তামু ভ্রমণের জন্যে । আমরা উঠে বসলাম বেশ বর একটা অটোতে । অটোর বর্মী চালকের সাথে আলাপ করার ইচ্ছা অধুরা থেকে গেলো ভাষার গেরোয় । অগত্যা রাজুকে দোভাষী বানিয়ে কাজ সারলাম । শুনলাম উত্তর পশ্চিম মায়ানমারের এই অংশে সীমান্ত শহর তামু প্রস্তাবিত ভারত মায়ানমার রেলপথের এবং ভারত থাইল্যান্ড আন্তর্জাতিক সড়কের অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ । আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল কেন্দ্রস্থল ও বটে । আবার এত্ত শুনলাম যে চীনা বা থাই পণ্যের চোরাচালানের ও এক অন্যতম কেন্দ্র । নতূন কিছু নয় , তৃতীয় বিশ্বের যেকোন আন্তর্জাতিক সীমান্ত শহরের ই বোধহয় এটি বৈশিষ্ট । রাস্তাঘাট দেখলাম বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন , তবে বিলাস বা বাহুল্যের অভাব । মহিলারা ছোট বাচ্চা কে পিঠে বেঁধে কাজে যাচ্ছে , দুপাশে অনেকটা ফাঁকা জায়গা কিন্তু সবুজ গাছে ভরা । খানিকক্ষণের মধ্যেই ইরাবতী নদীর উপরে ব্রিজ পেরিয়ে তামুর রাস্তাঘাট ও জনজীবন কিছুটা দেখতে দেখতে চলে এলাম একটি বৌদ্ধ প্যাগোডা কমপ্লেক্সে । কিছু জায়গায় মেরামত ও নির্মাণকার্য চলছিল । তার মধ্যে দিয়েই আমরা ঘুরে ঘুরে বুদ্ধ স্তুপ ও মন্দির দেখলাম । লক্ষ্য করলাম বেশ কিছু নানা বয়েসী বৌদ্ধ ভক্তের সমাগম । পুরুষরা প্যান্ট শার্ট পড়লেও মহিলারা দেখলাম ট্র্যাডিশনাল বার্মিজ পোশাক পড়েছেন , লুঙ্গি র মতন কাপড় অনেকটা স্কার্টের মতো গোড়ালি উচ্চতা পর্যন্ত পড়েছেন । অল্প বয়েসী মেয়েরাও তাই । ঘুরে ঘুরে তাঁরা বুদ্ধমূর্তি কিংবা স্তুপের সামনে ধূপ জ্বালাচ্ছেন । এক জায়গা থেকে দেখলাম নীচে বিস্তীর্ন তামু শহরটা দেখা যাচ্ছে । বুঝলাম মূল শহর থেকে অনেকটা উঠে এসেছি আমরা । ঘুরতে ঘুরতে এসে দেখলাম ঢালু ছাদ আলা কারুকার্যখচিত কতগুলি বিল্ডিং , মনে হল ওগুলি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ছাত্রাবাস । সুন্দর একটা অনুভূতি নিয়ে আবার অটো এ চেপে চলে এলাম নান ওও প্যাগোডা এ।এটি তামু শহরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ স্তুপ । দেখলাম এই চত্তরে অনেক ভক্তের ভীড় । মহিলাদের কপালে খড়িমাটির মতন কিছু দিয়ে লম্বা তিলক টানা অনেকটা মনিপুরের মৈতেই বৈষ্ণবদের মতন । গালে রুজের মতন গোল করে ওই খড়িমাটির ই মতন কিছু লাগানো । রাজুর কাছে শুনলাম এগুলো তানখা । ক্রান্তীয় অঞ্চলের সূর্যের প্রখর তাপের হাত থেকে ত্বক রক্ষা করার জন্যে এঁরা এরকম তানখা ব্যবহার করেন ।
বড় বৌদ্ধ মন্দিরের ভিতরে ঢুকে দেখি অনেক মানুষের ভীড় , সবাই জোড়াসনে বসে আছেন । সামনে জলদগম্ভীর কণ্ঠে এক বৃদ্ধ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অপরিচিত ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করে যাচ্ছেন , সাথে যোগ্য সঙ্গত করছেন সামনে বসা ভক্তগণ । সে এক অদ্ভুত পরিবেশ । সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশের মূর্ছনায় বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা সেখানে , তারপর ফেরার পথ ধরলাম । ফেরার পথে তামু চেকপোস্টের কাছেই বিখ্যাত নামফলং মার্কেটে ঢুকলাম , মনে হল যেন এক অন্য জগতে চলে এলাম । হাজার হাজার দোকানি ছোট বড় মাঝারি দোকানের পসরা সাজিয়ে বসেছে । কি নেই সেই পসরায় ! চাল ডাল তেল নুন নানাধরণের পাঁপড় ও খাবার জিনিস থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খেলনা , জামাকাপড় ও বিভিন্ন প্রকারের ইলেক্ট্রনিক দ্রব্যের সম্ভার চারিদিকে । সবই প্রায় মেড ইন চায়না ।নানাপ্রকারের হস্তশিল্প সামগ্রী ও বিক্রি হচ্ছে দেখলাম । টুকিটাকি কিছু হ্যান্ডিক্রাফটস কিনলাম আমরা । নানাপ্রকারের ক্রেতার ভীড় দেখতে লাগলাম , আর শুনলাম ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে বিচিত্র সব বাক্যালাপ , দরদামের নানা প্রক্রিয়া । যাঁরাই শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটে গেছেন তাঁরা অনেকটা মিল পাবেন এই নামফালং মার্কেটের সাথে । অনেককে দেখে মনে হল স্থানীয় মনিপুরী , চেকপোস্ট পেরিয়ে এখানে এসে অনেকটা সস্তায় নানা রকম জিনিস মূলতঃ ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী কিনে ইমফল বা মণিপুরের অন্যান্ন জায়গায় বিক্রী করবে বলে এসেছে । মাঝে টেংনুপালের চেকপোস্টের নজরদারি এড়িয়ে যেতে পারলেই হল । বুঝলাম চেকপোস্টের করা নিয়ম যেমন আছে , নিয়মের ফাঁকফোঁকর ও নিশ্চয়ই আছে । নইলে এতো মানুষ হামলে পরে এতো জিনিস কিনছেই বা কেন । নানারকম পণ্যের মিশ্র গন্ধ , নানারকম কথা বার্তার আশ্চর্য কলতান , নানারঙের বিভিন্ন পোশাকের মানুষজনের উপস্থিতি সবমিলিয়ে আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের উপরে তার বিরাট অভিঘাত পড়ল ।
দারুন একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে এবারে আবার ফেরার পথ ধরলাম । বিদেশ পেরিয়ে এবারে আবার স্বদেশে ।
চার ঘন্টার যাত্রা শেষে আজ আবার ফিরে আসব ইমফলে । ফেরার পথে বিকেল বিকেল এসে পড়লাম কাকচিঙে । কাকচিং গার্ডেনে কাটালাম বেশ খানিক্ষন । মহাদেব মন্দির , চিলড্রেন্স পার্ক , গোলাপ উদ্দ্যান ইত্যাদি সব মিলিয়ে কাকচিং বাজারের দক্ষিণে অবস্থিত এই কাকচিং গার্ডেন আমাদের বেশ ভালোই লাগল । স্থানীয় মানুষজনের ভালোই ভীড় দেখলাম ।
এবারে ফেরার পালা , একটু এসেই পথে পড়লো খংজম ওয়ার মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স । রাজু জানালেন যে ” খঙ্গজম ওয়ার মেমোরিয়াল কমপ্লেক্সটি মণিপুরের থৌবাল জেলার খঙ্গজম অঞ্চলের অ্যাংলো-মণিপুর যুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্থল। কমপ্লেক্সটিতে বিশ্বের বৃহত্তম তলোয়ারের মূর্তি রয়েছে, যা মনিপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও সাহসের প্রতীক, যারা ২৩ শে এপ্রিল, ১৮৯১ সালে কোহিমা, শিলচর ও মিয়ানমার থেকে ব্রিটিশদের হামলার তিন পক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন ।
1891 র এংলো -মণিপুরী যুদ্ধে মণিপুরের জন্য আত্মত্যাগী সকল সাহসী আত্মার স্মরণ হিসাবে প্রতিবছর ২৩-শে এপ্রিল খোঙ্গজম দিবস হিসাবে পালিত হয় । “
বেলা প্রায় পরে এসেছিল তখন । ভালো করে ঘুরে বেশ খানিক্ষন কাটিয়ে ছবি টবি যে তুলবো সেই উপায় ও নেই । অগত্যা তাই আমি একাই গাড়ী থেকে নেমে সেই গোধূলিকালে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম আর তারপর ফিরে চললাম রাজধানী ইমফালের উদেশ্যে । জানালা দিয়ে তখন দেখা যাচ্ছিল আদিগন্ত বিস্তৃত জমির প্রেক্ষাপটে বিদায়ী সূর্যের মোহময়ী দৃশ্য । সারাদিনের প্রচুর ঘোরাঘুরির ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে এলো । ঘুম ভাঙলো অনেক্ষন পর ইমফাল শহরে ঢুকে । আবার সেই পোলো হোটেল ।
কাল সকালেই বেরিয়ে আমরা যাবো উত্তর দিকে পার্বত্য মণিপুরের উখরুলে যেখানে তাংখুল নাগা আদিবাসীদের বাস ।
(পরবর্তী সংখ্যায়ে সমাপ্ত)
Leave a Reply