দ্বিতীয় পর্ব
স্থান – শ্রীনগর, জম্মু-কাশ্মীর
সময়- এপ্রিল , ২০১২ যাত্রীগণ – মনার্ক ট্রাভেল এর সহযাত্রীগণ
লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত
চিয়াং মাইয়ের পুষ্পোৎসবের পর এটা এই সিরিজের দ্বিতীয় প্রতিবেদন। প্রতি বছর শ্রীনগরের টিউলিপ গার্ডেনে বসন্তের শুরুতে মার্চ থেকে টিউলিপের কুঁড়ি গুলি যখন ফোঁটার জন্য প্রস্তুত তখন এই টিউলিপ উৎসবের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সাধারনতঃ প্রতি বছর এপ্রিল মাস থেকে এই উৎসব শুরু হয়।
এটি এশিয়ার বৃহত্তম টিউলিপ উদ্যানগুলির মধ্যে একটি। ৫৬০০ ফুট উঁচু জবারওয়ান পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত এই বাগানটিতে টিউলিপ ছাড়াও ড্যাফোডিলস, হায়াসিনথস, গোলাপ, মাস্কারিয়া, আইরিস ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির ফুল দেখতে পাওয়া যায়। এই উৎসবটি পনেরো দিন বা এক মাস অবধি স্থায়ী হয় যাতে বিভিন্ন ফুল বিভিন্ন সময়ে ফুটে রঙের রামধনুর সৃষ্টি করে। প্রতিবছর আবহাওয়ার গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে এই টিউলিপ উৎসব শুরু হয়।
টিউলিপ গার্ডেন একটি সাত-স্তরযুক্ত বাগান যা এই পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। টিউলিপ উৎসবে বিভিন্ন ধরণের সচরাচর দেখা টিউলিপের পাশাপাশি হাইব্রিড টিউলিপও প্রদর্শিত হয়। এই উদ্যানের চারপাশের গাছগুলি পত্র পুষ্পে শোভিত হয়ে স্থানটিকে আরও মনোরম করে তোলে। টিউলিপ ফেস্টিভ্যালে বিভিন্ন ধরনের টিউলিপ দেখতে পাওয়া যায় যেমন স্ট্যান্ডার্ড টিউলিপ – এটি সাধারণ টিউলিপ যা স্থানীয় বাগানে পাওয়া যায়, ডাবল ব্লুম – একক পাপড়ির পরিবর্তে অনেকগুলি স্তর রয়েছে, দুই রঙের স্ট্যান্ডার্ড টিউলিপ, রেমব্র্যান্ডট – ফ্যাকাশে বর্ণের লম্বা টিউলিপ, ফস্টেরিয়ানা টিউলিপ – এগুলি সুন্দর কুঁড়ি যুক্ত বিভিন্ন উচ্চতার হয়, লিলি টিউলিপ – এই ফুলগুলির মাথা আর্চের মত দেখতে আর দীর্ঘ সূচাল পাপড়ি রয়েছে, ট্রায়াম্ফ – জাঁকজমকপূর্ণ রঙ বিশিষ্ট দ্বি বর্ণের টিউলিপ।
টিউলিপ বাগান এই গ্রীষ্মের মরশুমে শ্রীনগরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি দর্শনীয় স্থান। ডাল হ্রদের সন্নিকটে অবস্থিত এই পার্কটি চারপাশে মনোরম পাহাড় ও মোঘল যুগের আকর্ষণীয় উদ্যানগুলি দ্বারা বেষ্টিত । শ্রীনগরের অন্যান্য কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থান হল চশমে শাহী গার্ডেন, পরী মহল , শঙ্করাচার্য মন্দির , নিশাত উদ্যান, মুঘল উদ্যান ইত্যাদি।
ডাল লেক তার অতুলনীয় প্রশান্তি নিয়ে সুদূর অতীত কাল থেকে মানুষকে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ করেছে। নৌকা বা শিকারায় করে হ্রদের মধ্যে পরিক্রমা যুগযুগ ধরে ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণ করেছে। দূরে পাহাড়ের ছায়া এবং হ্রদের মধ্যেকার ফোয়ারা গুলি যখন জলে প্রতিবিম্বিত হয় তখন তা অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা সৃষ্টি করে। হ্রদের মধ্যে নৌকা বিহারের সময় পাহাড়ের মাথায় সম্রাট আকবরের সময়কার তৈরি একটা বহু পুরোনো কেল্লা দেখা যায়। লেকের পিছন দিকে হাউস বোট গুলি পেরিয়ে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে ভাসমান বাগান যেখানে তরিতরকারী ফলে আছে। স্থানীয় অধিবাসীরা নৌকায় করে এইসব তরিতরকারী বিক্রী করছে দেখা যায়। তবে হাউস বোটগুলি থেকে নির্গত বর্জ্যজনিত দূষণ জলের গুণমান এবং হ্রদের ইকোসিস্টেমগুলির সূক্ষ্ম ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। তবে ভারত সরকার হ্রদটিকে তার পূর্বের গৌরবে ফিরিয়ে আনতে একটি বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
শ্রীনগরের শহর ছাড়িয়ে আশে পাশে রাস্তার দুপাশের নয়ন মুগ্ধকর সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। কোথাও পাহাড়ের কোলে হলুদ সরষের ক্ষেত, কোথাও পীচ ফলের গাছ, আপেলের বাগান, রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদী অথবা দূরের পীরপাঞ্জাল পর্বত শ্রেনী। সোনামার্গ যাবার পথে পড়বে বরফ ঢাকা পাহাড়, গ্লেসিয়ার থেকে উৎপন্ন স্বচ্ছতোয়া নদীর ধারা, পাহাড়ের গায়ে বরফে ঢাকা ঝাউ এর বন। আক্ষরিক অর্থে মনে হবে যেন স্বর্গ নেমে এসেছে পৃথিবীর মাঝে। প্রাচীন সিল্ক রোডের প্রবেশদ্বার হিসাবে সোনামার্গের ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে যা জম্মু ও কাশ্মীরকে তিব্বতের সাথে সংযুক্ত করেছিল। আজ এই হিল স্টেশনটি ভ্রমণকারীদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাথে কারগিল যুদ্ধের পর সোনামার্গ ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য এক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
এই রাস্তা দিয়ে সোজা গেলে জোজিলা পাস হয়ে দ্রাস ও কারগিল পর্যন্ত যাওয়া যায়। সোনামার্গ থেকে বালতাল হয়ে অমরনাথ পর্যন্ত ট্রেকিং করে যাওয়া যায়। কাছাকাছি অনেকগুলি উঁচু চূড়া এবং গ্লেসিয়ার দেখতে পাওয়া যায়। এখান থেকে উৎপত্তি হয়ে তিনটি শাখা নদী লিডার, সিন্ধ এবং নীলম একে অপরের সাথে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে কাশ্মীর উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঝিলাম নদীতে গিয়ে মিশেছে।
Leave a Reply