স্থান – চিয়াং মাই ও চিয়াং রাই , থাইল্যান্ড
সময়- ফেব্রুয়ারী, ২০২০ যাত্রীগণ – মনিদীপা দাশগুপ্ত ও দেবাশিস দাশগুপ্ত
লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত
প্রথম পর্ব
ফুল ভালো বাসেনা এই রকম লোক আশা করি আপনি ভূ-ভারতে খুঁজে পাবেননা। একটি ফুল দিয়ে যদি কাউকে বলেন ঈশ্বরের সুন্দর সৃষ্টি আপনাকে দিলাম – তবে সে মনে মনে সবচেয়ে বেশী খুশী হবে। তাই ফুল নিয়ে আদিখ্যেতা পৃথিবীর সবত্র লক্ষ্যনীয় । ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও পরম্পরা অনুসারে বিশ্বের অনেক জায়গায় পুষ্পোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আমার সৌভাগ্য যে এই জাতীয় তিনটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছি – একটি টিউলিপ উৎসব শ্রীনগরে এবং অন্য দুটি গোলাপ উৎসব বুলগেরিয়ার কাজানলুকে এবং পুষ্পোৎসব থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই শহরে ।
প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব চিয়াং মাইয়ের পুষ্পোৎসব সম্পর্কিত । আমরা ব্যাঙ্কক হয়ে প্রথমে গেলাম ফুকেট। সেখানে দুদিন কাটিয়ে এলাম চিয়াং মাই শহরে। এই উৎসব প্রতিবছর বসন্তের আগমনে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহান্তে (শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত) অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই উৎসব চলাকালীন, ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো ট্যাবলো নিয়ে সুসজ্জিতা মহিলারা, স্থানীয় স্কুলইউনিফর্মে ব্যান্ড সমেত ছাত্ররা এবং ঐতিহ্যবাহী থাই পোশাক পরা নৃত্যশিল্পীরা শোভাযাত্রা করে রাস্তা দিয়ে যায় এবং রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় মানুষ জন এবং বিদেশী ট্যুরিস্টরা তাদের উৎসাহিত করেন।
সাধারণতঃ সকাল ৮ টায় শোভাযাত্রা শুরু হয় এবং নির্দিষ্ট বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে ঘুরে শেষে নংগ হাদ বুয়ক পার্কে শেষ হয়।শোভাযাত্রা চলাকালীন রাস্তাগুলি সমস্ত ট্র্যাফিকের জন্য বন্ধ থাকে।
বিচারকদের পক্ষে বিজয়ীদের বাছাই করার জন্য ফুলের সজ্জা, বনসাই গাছ, আলংকারিক গাছপালা এবং ফুলগুলি প্রদর্শনীর জন্য রাখা থাকে নংগ হাদ বুয়াক পাবলিক পার্কে। যদিও বড় গ্রুপ গুলি সৃজনশীলতা এবং সৌন্দর্যে একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রতিযোগিতায় কেউ কারো থেকে কম যায়না, সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রতিযোগিতাটি হয় চিয়াং মাই ফ্লাওয়ার কুইনকে সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় বেছে নেওয়াকে কেন্দ্র করে। অর্কিড প্রেমীরা স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বারা সৃষ্ট সুন্দর জাতের অর্কিডগুলি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করেন না।
চিয়াং মাই ফ্লাওয়ার ফেস্টিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুক্রবার সকালে নংগ হাদ বুয়াক পার্কে ফুলের সাজ, শোভাময় গাছপালা ও ফুলের প্রদর্শনীর সাথে শুরু হয়। অনুষ্ঠানের সব চেয়ে আকর্ষণীয় পর্বটি হয় সন্ধ্যা সাতটায় – তারপরে ফুলের উৎসবের রানির সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাটি শুক্রবার রাত ৮ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত চলে। এই পাবলিক পার্কটি শহরের চতুর্দিকে বেষ্টিত পরিখার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত এবং ফুল উৎসব চলাকালীন যে কোনও সময় ঘুরে দেখার জন্য খুবই সুবিধাজনক। এইসময় পার্কটি ফুলের উৎসবের জন্য সুন্দরভাবে সজ্জিত থাকে।
বাচ্চাদের খুশি রাখতে পার্কটিতে একটি বড় খেলার মাঠ রয়েছে ।খুব ভোরে এখানে একটি প্যারেড হয় যেখানে ভাসমানগুলি ফ্লোট গুলি ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো হয়। প্রতিটি ফ্লোট সত্যই দেখার মতো এবং সন্ধ্যায় সেরা ফ্লোটের বিজয়ী ঘোষণা করা হয় । এখানে ফুলের বাজারও আছে যেখানে নিজস্ব বাগানের জন্য বিরল বা বিদেশী ফুল কিনতে পারা যায়। সন্ধ্যায় শহরটির চারপাশে থ্রি কিং স্মৃতিস্তম্ভ, থাপে গেট এবং পার্কে পারফরমেন্স অনুষ্ঠিত হয়।উৎসবের শেষে সমাপনী অনুষ্ঠানগুলিও দেখবার মতো।
চিয়াংমাই, উত্তর থাইল্যান্ডের বৃহত্তম শহর এবং চিয়াং মাই প্রদেশের রাজধানী। এই পাহাড়ী অঞ্চলটি ব্যাংককের ৭০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। চিয়াং মাই অর্থাৎ থাই ভাষায় “নতুন শহর” ১২৯৬ সালে ল্যান না-র নতুন রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আগের রাজধানী ছিল চিয়াং রাই। পিং নদীর উপর অবস্থিত এই শহর। বিদেশী শক্তির আক্রমন থেকে রক্ষা করার জন্য শহরটি একটি পরিখা এবং প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল যার ভগ্নাংশ আজও শহরে বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়বে। কাছাকাছি বামার জনগণের টাঙ্গু রাজবংশ এবং মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী যারা চীনের ইউনান প্রদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল জয় করেছিল তাদের থেকে আক্রমণের আশঙ্কা ছিল।
ল্যান না-এর পতনের সাথে সাথে, এই শহরটির গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং ১৫৫৬ সালে তা টাঙ্গুর দখলে চলে যায় । পরে থোনবুরির রাজা টাঙ্গু বামারকে তাড়িয়ে দিতে সাহায্য করার পরে চিয়া কাভিলার সাথে চুক্তি করে চিয়াং মাই আনুষ্ঠানিকভাবে থোনবুরি রাজ্যের অংশ হয়েছিল। পরবর্তী টাঙ্গুর পাল্টা আক্রমণের ( ১৭৬৬- ১৭৯১) মধ্য দিয়ে চিয়াং মাইয়ের পুরোনো গৌরব ক্রমশঃ লুপ্ত হয়। এর বহু পরে চিয়াং মাই উত্তর থাইল্যান্ডের আনুষ্ঠানিক রাজধানী হিসাবে ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব ফিরে পায়।
ফুলের উৎসব শেষে চিয়াং মাই শহরের বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির গুলি দেখলাম।পুরানো প্রাচীরযুক্ত শহরের মধ্যে অবস্থিত জেডি লুয়াং হচ্ছে চিয়াং মাইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। ১৩৯১ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল এবং ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে এটি শেষ হয়। এখানকার এমারাল্ড বুদ্ধ মূর্তি যা সবচেয়ে পূজ্য বলে গণ্য হতো পরে তা লাওসে চলে গিয়েছিল এবং অবশেষে আবার দেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং বর্তমানে ব্যাংককের এক মন্দিরে স্থাপিত আছে। ১৫৪৫ সালে এই অঞ্চলে এক বিরাট ভূমিকম্প হয়েছিল যা বেশিরভাগ ঐতিহাসিক সৌধকে ধ্বংস করেদিয়েছিল তবে ১৯৯০ এর দশকে এই মন্দিরটি আংশিকভাবে সংস্কার করা হয়েছিল।
সিঁড়ির শীর্ষে কুলুঙ্গিতে বুদ্ধের মূর্তি স্থাপিত আছে। সিঁড়ির ঠিক নীচে অনেকগুলি পাথরের হাতি দ্বারা সজ্জিত একটি প্ল্যাটফর্ম আছে। প্রবেশদ্বারের বিপরীতে অভয় মুদ্রা ভঙ্গিতে দাঁড়ানো বুদ্ধের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিহারটি আরও ছোট – কিন্তু পালিশ কাঠের খোদাই সহ সুন্দরভাবে সজ্জিত । এই বিহারের পাশেই একটি ছোট বার্মিজ স্টাইলের মন্দির আছে। এই মন্দিরটি পুরানো প্রাচীরঘেরা শহর চিয়াং মাইয়ের কেন্দ্রে অবস্থিত।
ওয়াট দোই সুথেপ উত্তর থাইল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিখ্যাত মন্দির। ওয়াট দোই সুথেপ চিয়াং মাইয়ের প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পর্বতমালার উপরে অবস্থিত। গাড়ি পার্ক করার জায়গা থেকে প্রায় তিনশটি সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে শীর্ষে উঠতে হয়। তবে যাত্রীগণের সুবিধার কথা ভেবে কেবল কারের সুব্যবস্থাও আছে। উপরে উঠে সোনার পাতে মোড়া বিভিন্ন মন্দির ও তৎসংলগ্ন বুদ্ধ মূর্তি সমূহের সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এই স্থান থেকে চিয়াং মাই শহর ও ন্যাশনাল পার্কের সৌন্দর্য অতুলনীয়।
চিয়াং রাই শহরটি ১২৬২ সালে রাজা মাঙ্গরাই কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মাঙ্গরাই রাজবংশের রাজধানী হয়ে ওঠে। ‘চিয়াং’ শব্দের অর্থ থাই ভাষায় ‘শহর’, তাই চিয়াং রাই মানে ‘ মাঙ্গরাইয়ের শহর ‘। পরবর্তী কালে চিয়াং রাই বার্মা দ্বারা পরাজিত হয় এবং কয়েকশত বছর বার্মিজ শাসনের অধীনে ছিল। শ্যাম দেশ (থাইল্যান্ড) ১৮৯৯ সালে চিয়াং মাই দখল করে এবং চিয়াং রাই ১৯৩৩ সালে থাইল্যান্ড এর একটি প্রদেশ ঘোষিত হয়। আমরা চিয়াংমাই থেকে একদিন সকালে বেরিয়ে চিয়াং রাই দেখে আবার রাত্রে ফিরে এলাম।
চিয়াং মাই থেকে চিয়াং রাই যাবার পথটি বেশ সুন্দর। যাবার পথে অনেক গুলি হট স্প্রিং আছে। তার মধ্যে একটির কাছে আমরা গাড়ী দাঁড় করিয়ে ফটো তুললাম। দূরে দেখলাম কয়েকটি হট স্প্রিং থেকে ফোয়ারার মত গরম জল এবং ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে – কাছে গেলে সালফারের গন্ধ পাওয়া যায়। দেখলাম কিছু স্থানীয় লোকেরা ডিম বিক্রি করছে – তারা ডিমগুলিকে একটি ছোট বাঁশের ঝুড়িতে রেখে হট স্প্রিং এর কুয়োর মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। দুই বা তিন মিনিট পরে সেদ্ধ হয়ে যাওয়া ডিমগুলি বের করে আনা হয়। যেখানে হট স্প্রিং পুলের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম সেখানে দেখলাম পর্যটকরা পা ভিজিয়ে বসে আছে – তাদের দেখে মনে হল যে অভিজ্ঞতাটা নিশ্চয়ই বেশ আরামদায়ক।
চিয়াং রাইতে দেখার মন্দিরগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ওয়াট রং খুন বা ‘হোয়াইট টেম্পল ‘। বিখ্যাত মন্দিরটি জাতীয় শিল্পী ভিজ্যুয়াল আর্টস (চিত্রাঙ্কন) চেরেমচাই কোসিতপীপত দ্বারা পরিকল্পিত। এর নকশার কাজ ও তৈরি করার সকল খুঁটিনাটি তিনিই সম্পন্ন করেছেন। এই হোয়াইট টেম্পল সাদা রঙের স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে এবং রৌপ্যময় চকচকে আয়না দিয়ে সজ্জিত। প্রবেশ পথের আর্চের নীচেটা সর্প চিত্র দ্বারা অলঙ্কৃত । অভ্যন্তরের দেওয়াল গুলি অসাধারণ মুরাল চিত্র দ্বারা শোভিত। এছাড়াও এই বিখ্যাত শিল্পী এবং তার অনুসারীদের কাজগুলি প্রদর্শন করার জন্য একটি গ্যালারী রয়েছে যা দেখতে সবাই আগ্রহী এবং সকলকেই তা আকর্ষণ করে।
চিয়াং রাইয়ের পরবর্তী আকর্ষণীয় মন্দিরটী হচ্ছে ওয়াট রং সুয়া টেন বা ‘ব্লু টেম্পল’। এই নীল মন্দিরটি আক্ষরিক অর্থেই দুর্দান্ত এক মার্জিত শিল্পকর্ম। এই মঠের স্থাপত্য অসাধারণ –এর সমস্ত দেয়াল এবং সিলিংয়ের সূক্ষ্ম মুরাল পেইন্টিং গুলি অসামান্য নীল রঙে নজরকাড়া। মন্দিরটি তার স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে ।এই মন্দিরটি স্থানীয় শিল্পী “ফুট্টা কার্বকিউ” দ্বারা নকশাকৃত এবং নির্মিত হয়েছিল যা তৈরি করতে সময় নিয়েছিল প্রায় ১১ বছর।
উত্তর থাইল্যান্ডের এই সুন্দর শহর দুটি দেখার পরে আমরা ফিরে এলাম ব্যাংককে – সেখানে চারদিন কাটিয়ে আমরা দেশে ফিরে যাব।
অত্যন্ত সুন্দর ও তথ্যসমৃদ্ধ লেখা, থাইল্যান্ডের দুটি অপরিচিত স্থানকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, আরও লেখার অপেক্ষায় রইলাম