স্থান – লাসা
সময়- মে-জুন , ২০১৫ যাত্রীগণ – ভয়েজার্স ক্লাবের সহযাত্রীগণ
লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত
সাংহাই হচ্ছে সমুদ্র পৃষ্ঠে আর লাসা হচ্ছে পৃথিবীর ছাদ – আমাদের পরিকল্পনা ছিল সাংহাই থেকে লাসা এই দীর্ঘ ৪৩০০ কিলোমিটার যাত্রা পথ আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলপথ যা কিনা কিংহাই-তিব্বত রেলপথ নামে পরিচিত তাতে পাড়ি দেব। এই দীর্ঘ সময়ে অর্থাৎ প্রায় ৪৮ ঘণ্টায় আমরা ধীরে ধীরে এই অধিক উচ্চতা জনিত সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারব, যার ফলে আমরা লাসা পৌঁছে শারীরিক ভাবে সুস্থই থাকব। আরও একটা ব্যাপার ছিল – যাওয়ার সময় ট্রেনে গেলে কিছু কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন কুনলুন পর্বত শ্রেণী, গোবি মরুভুমি এসব দিনের আলোতে দেখতে পারতাম। কিন্তু বিধি বাম- ট্রেনে যাবার টিকিট না পাওয়ায় আমরা প্লেনে গিয়ে ট্রেনে ফিরব ঠিক হলো।
চীনের সবচেয়ে বড় নদী ইয়াঙ্গৎসে টাঙ্গুলা পর্বত শ্রেনীর গ্লেসিয়ার থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং দীর্ঘ পথ চলা শেষে সাংহাইয়ের কাছে পূর্ব চীন সমুদ্রে মিলেছে। কাকতালীয় ভাবে ফেরার সময় আমরাও এইখান থেকে যাত্রা শুরু করে সাংহাইতে গিয়ে যাত্রা শেষ করব, যদিও মাঝখানের যাত্রা পথটা অনেকটাই আলাদা।
সাংহাই থেকে রওয়ানা হয়ে যথা সময়ে সন্ধ্যা বেলায় আমরা লাসা এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। একেবারে শূন্য মিটার থেকে প্রায় ১২ হাজার মিটার উচ্চতায়। যথাসম্ভব কম পরিশ্রম করতে হবে আগামী ২৪ ঘন্টায় যাতে শরীর এখানকার কম অক্সিজেনের বায়ুমন্ডলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যে সমুদ্র পৃষ্ঠের তুলনায় এখানে অক্সিজেনের মাত্রা ৪০-৫০ শতাংশ কম। সাথে কিছু ওষুধ ছিল যেটা খেয়ে নিলে এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সুবিধা হবে। লাসায় আমরা দেখবো পোতালা প্যালেস, জোখাং টেম্পল, দ্রেপুং মনাস্টেরি, সামার প্যালেস ইত্যাদি। পোতালা প্যালেস তিব্বতের সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতীক। এটাই ছিল দলাইলামার পূর্বতন বাসস্থান। এর ভেতরে অনেক প্রাচীন পুঁথি ও থাঙ্কা আছে যা তিব্বতিয় বৌদ্ধ ধর্মের মুল্যবান সম্পদ। লাসায় তিন দিন দ্রষ্টব্য যায়গাগুলি দেখে তারপর আমরা ফিরবো ট্রেনে।
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩৬৫৮ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত লাসা শহর। ‘লাসা’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ তিব্বতি ভাষায় “পবিত্র ভূমি” । তিব্বতের আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত এই শহর। গভীর নীল আকাশ, উজ্জ্বল সূর্যালোক, এবং মনোমুগ্ধকর পাহাড়ী দৃশ্যের সৌন্দর্যে সম্পৃক্ত লাসা প্রচুর দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যটক এবং তিব্বতি তীর্থযাত্রীদের আকৃষ্ট করে। সুন্দর লাসা উপত্যকায় অবস্থিত প্রাচীনতম লাসা শহরটি সপ্তম শতাব্দীতে জোখাং মন্দির এবং রামোচে মন্দিরকে ঘিরে থাকা একটি ছোট শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। পবিত্র পোতালা প্রাসাদ নির্মাণ হওয়ার পরেই লাসা আক্ষরিক অর্থে তিব্বতের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। অনেক দর্শনার্থীর কাছেই লাসা শহরটি হচ্ছে পোতালা প্রাসাদ, জোখাং মন্দির, সেরা মঠ, ড্রেপুং মঠ এবং লাসা নদী নিয়ে গঠিত – এর সব কটির রস আস্বাদন না করলে লাসা শহরকে পুরোপুরি বোঝা যাবেনা। কিন্তু তার আগে লাসার ইতিহাসের কিছু পাতা উল্টে দেখা যাক।
সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সোংটসেন গাম্পো তিব্বত রাজ্যের নেতা হয়ে ওঠেন যেটি তখন ব্রহ্মপুত্র (স্থানীয়ভাবে ইয়ারলুং সাংপো নদী নামে পরিচিত) উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিমের রাজ্য জয় করার পর তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেন রাসা বা লাসায়। মারপোরি পর্বত অঞ্চলে ৬৩৭ সালে তিনি প্রথম নির্মাণ শুরু করেন যেখানে পরে পোতালা প্রাসাদ গড়ে ওঠে। ৬৩৯ এবং ৬৪১ সালের মধ্যে তিনি পুরো তিব্বত অঞ্চল জয় করেছিলেন । নবম শতাব্দীতে রাজা লাংদারমার শাসন কালে লাসা ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তখন পবিত্র স্থানগুলি ধ্বংস ও অপবিত্র করা হয় এবং এই সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায়। নবম শতাব্দীতে রাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে পঞ্চম দালাই লামার রাজ্যে যোগদান পর্যন্ত লাসা তিব্বত অঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল না। যাই হোক শতাব্দীর অগ্রগতির সাথে সাথে ধর্মীয় স্থান হিসাবে লাসার গুরুত্ব ক্রমশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি পুনরায় তিব্বতের মুখ্য কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত হয়ে। সেই সময় সেখানে ধর্মগুরু পদ্মসম্ভব জোখাং মন্দিরের সংস্কার করে নতুন করে তার ভিত্তি স্থাপনা করেন।
পঞ্চদশ শতকের মধ্যে জে সোংখাপা এবং তার শিষ্যদের দ্বারা তিনটি বৃহৎ গেলুগপা মঠ প্রতিষ্ঠার পর লাসা শহরটি আবার তার বৈশিষ্ট্য ফিরে পায়। এই তিনটি মঠ হল গ্যান্ডেন, সেরা এবং ড্রেপুং যেগুলি তিব্বতে রক্ষণশীল বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুজ্জীবনের অংশ হিসাবে নির্মিত হয়েছিল।
এই গেলুগপা বংশের পণ্ডিতদের সাফল্য এবং রাজনৈতিক জ্ঞান অবশেষে লাসাকে আরও একবার খ্যাতির কেন্দ্রে নিয়ে যায়। পঞ্চম দালাই লামা লোবসাং গিয়াৎসো (১৬১৭-১৬৮২), তিব্বতকে আবার এক সূত্রে আবদ্ধ করেন এবং গুশি খানের সহায়তায় ১৬৪২ সালে তাঁর প্রশাসনের কেন্দ্র লাসাতে স্থানান্তরিত করেন। গুশি খানের শাসক হিসেবে বিশেষ আগ্রহ না থাকায় পঞ্চম দালাই লামা এবং তার ঘনিষ্ঠরা একটি বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাকে ইতিহাসবিদরা লাসা রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই সরকারের মূল নেতৃত্বকে গ্যান্ডেন ফোড্রং নামেও উল্লেখ করা হয় এবং তারপরে লাসা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় দিকেই রাজধানী হয়ে ওঠে। ১৬৪৫ সালে, পাহাড়ের উপরে পোতালা প্রাসাদের পুনর্নির্মাণ শুরু হয়। ১৬৪৮ সালে পোতালার সাদা প্রাসাদ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় এবং সেই সময় থেকে দালাই লামা পোতালাকে শীতকালীন প্রাসাদ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। পোতালার লাল প্রাসাদ ১৬৯০ এবং ১৬৯৪ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। পোতালা নামটি পোতালাকা পর্বত থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা দালাই লামার, যিনি বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের ঐশ্বরিক অবতার হিসেবে গন্য হন তাঁর পৌরাণিক বাসস্থান। জোখাং মন্দিরটিও এই সময়ে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছিল।
সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে, লাসার বারখোর এলাকায় বিদেশী পণ্যের জন্য একটি জমজমাট বাজার তৈরি হয়েছিল। এই শহরে মঙ্গোল, চীনা, রাশিয়ান, আর্মেনিয়ান, কাশ্মীরি, নেপালি এবং উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীদের একটি বিশ্বজনীন বাজার ছিল। চিনি, চা, জাফরান, পার্সিয়ান টারকোয়েজ , ইউরোপীয় অ্যাম্বার এবং ভূমধ্যসাগরীয় প্রবালের বিনিময়ে তিব্বত কস্তুরী, সোনা, ঔষধি গাছ, পশম এবং ইয়াকের লেজ দূর-দূরান্তের বাজারে রপ্তানি হত। ১৭২০ সালে কিং রাজবংশের সেনাবাহিনী লাসায় প্রবেশ করে। ১৭৫০ সালে শহরে একটি দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে যার ফলে শতাধিক লোক নিহত হয়। বিদ্রোহীদের দমন করার পর, কিং কিয়ানলং সম্রাট তিব্বত সরকারকে পুনর্গঠন করেন এবং একটি গভর্নিং কাউন্সিল গঠন করেন। ১৯০৪ সালে ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ডের নেতৃত্বে একটি ব্রিটিশ অভিযাত্রী বাহিনী লাসায় প্রবেশ করে এবং নিচুতলার তিব্বতি কর্মকর্তাদের লাসা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। চুক্তিটি পরবর্তীকালে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং ১৯০৬ সালে একটি অ্যাংলো-চীনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯১২ সালে সিনহাই লাসা গোলযোগের পর সমস্ত কিং সৈন্য লাসা ত্যাগ করে।
বিংশ শতকের মধ্যে লাসা তিব্বতি এবং বিদেশী উভয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য একটি সম্ভাবনাময় যুগের সূচনা করে। সেখানে তখন অনেক জাতিগত এবং ধর্মীয়ভাবে স্বতন্ত্র সম্প্রদায় ছিল – তাদের মধ্যে ছিল কাশ্মীরি মুসলমান, লাদাখি বণিক, ইসলাম ধর্মান্তরিত শিখ এবং চীনা ব্যবসায়ী এবং কর্মকর্তারা। বিশ্ব বাজারে উপলব্ধ হেন কোন জিনিস ছিল না যা এখানে কেনা বেচা হত না। কমিউনিস্ট চীনা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর পিপলস লিবারেশন আর্মি ১৯৫০ সালে তিব্বত আক্রমণ করে । চীনা সরকারী সৈন্য এবং প্রশাসনিক ক্যাডারদের আগমনের পর এই ধরনের বিশ্বজনীন বাজারের আকস্মিক অবসান ঘটে। সেই স্থান দখল করে রেশন দোকান এবং স্বল্প পণ্য মজুত করা সরকারী দোকানগুলি। ১৯৯০ এর দশকে আবার আন্তর্জাতিক পণ্য-বাণিজ্য লাসাতে ফিরে আসে এবং শপিং মল এবং আর্কেডগুলির প্রাধান্য চোখে পড়ে।
১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে রাজধানী লাসাকে কেন্দ্র করে একটি বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং সেই সময় দালাই লামা (চতুর্দশ), তেনজিন গ্যাৎসো (জন্ম ১৯৩৫) নির্বাসনে পালিয়ে যান ভারতে । প্রথমে ভারতের মুসৌরি শহর এবং পড়ে ধরমশালা শহরে নির্বাসিত অবস্থায় তিনি স্বাধীন তিব্বতি সরকার গঠন করেন। তিব্বতে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করতে ২০১১ সালে তিনি রাজনৈতিক প্রধানের পদ থেকে অবসর গ্রহন করেন।
লাসা শহরকে ঘিরে থাকা ২২ টি পার্কের মধ্যে আজ মাত্র তিনটি টিকে আছে। নরবুলিংকা যা দালাই লামার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ হিসেবে খ্যাত (নির্মিত হয়েছিল সপ্তম দালাই লামার সময়), শুগত্রী লিংকার একটি ছোট অংশ এবং লুখাং। শহরের বাকি অংশে ডরমেটরি ব্লক, অফিস এবং সেনা ব্যারাক তৈরি করা হয়েছে।১৯৮৭-১৯৮৯ সালের মধ্যে লাসায় চীন সরকারের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে বড় ধরনের বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। ১৯৯২ সালে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সঙ্গে সঙ্গে লাসায় অনেক সামাজিক পরিবর্তনও ঘটে । সমস্ত সরকারী কর্মচারী ও তাদের পরিবার এবং ছাত্রদের ধর্ম পালন করতে নিষেধ করা হয়। সন্ন্যাসীদের সরকারী অফিস এবং তিব্বত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতির প্রবর্তনের পর, অভিবাসীদের আগমনের ফলে লাসা শহরের জাতিগত সংমিশ্রণের নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়েছে যা সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬৩ শতাংশ তিব্বতি, ৩৪.৩ হান এবং বাকি ২.৭ হুই । যদিও বিদেশী পর্যবেক্ষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেন যে অ-তিব্বতিরা জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ দখল করেছে। লাসা শহর বহু দিন ধরে ছিল ‘নিষিদ্ধ নগরী’ । এমনকি আজকের দিনে অর্থাৎ ২০১৫ সালেও বিদেশীদের লাসা ভ্রমণের উপরে কিছু কিছু নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। আপাত দৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও কর্তৃপক্ষের শ্যেন দৃষ্টি রয়েছে এখানকার ধর্ম বিশ্বাসী মানুষজনের উপর। দালাই লামার নাম এখানে অনুচ্চারিত কিন্তু তাঁর নাম রয়েছে সবার হৃদয়ে। তাই স্বাভাবিক কারণেই ভারতীয় দের প্রতি তিব্বতি জনগনের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা উপলব্ধি করেছি সর্বত্র। আর একটা জিনিস যা লক্ষ্য করেছি তা হল চিনা আর তিব্বতিদের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা – এটা তাদের আচার আচরণ এবং শরীরী ভাষায় ভীষণ ভাবে প্রকট।
লাসা শহরের পরিকাঠামো যথেষ্ট উন্নত – সড়ক, রেল এবং বিমান পরিষেবার মাধ্যমে তা বিভিন্ন শহরের সঙ্গে যুক্ত। সিচুয়ান এবং কিংহাই প্রদেশের প্রধান শহর এবং জিনজিয়াংয়ের উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সাথে লাসা সড়কপথে সংযুক্ত। লাসার আধুনিক বিমানবন্দর বেইজিং ও অন্যান্য প্রধান চীনা শহর এবং নেপালের কাঠমান্ডুর মধ্যে যাত্রী পরিষেবা প্রদান করে। ২০০৬ সালে লাসা এবং কিংহাই প্রদেশের গোলমুদের মধ্যে সংযোগকারী একটি রেললাইন চালু করা হয়েছিল। পর্যটন স্থানীয় অর্থনীতির একটি ক্রমবর্ধমান এবং গুরুত্বপূর্ণ দিক যা লাসাকে দেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক শহরগুলির মধ্যে অন্যতম গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। পোতালা প্রাসাদ ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে মনোনীত হয়েছিল; জোখাং মন্দির এবং নরবুগলিংকা যথাক্রমে ২০০০ এবং ২০০১ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছিল। শহরের উচ্চ শিক্ষার প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখযোগ্য তিব্বত বিশ্ববিদ্যালয়, যা ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৯৮৫ সালে পুনর্গঠিত হয়েছিল।
ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান থেকে চোখ সরিয়ে এবারে লাসার সাংস্কৃতিক আর ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বোঝবার একটু চেষ্টা করা যাক। পোতালা প্রাসাদ দক্ষিণ তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অন্তর্গত লাসায় একটি বিশাল ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কমপ্লেক্স। এটি লাসা নদী উপত্যকা থেকে ৪২৫ ফুট উপরে মারপোরি (লাল পর্বত) এর উপরে অবস্থিত এবং এর পাথুরে ভিত্তি থেকে এই প্রাসাদের নির্মাণ কার্য্য ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠে এসেছে। পোত্রাং কার্পো বা হোয়াইট প্যালেস যা এক সময় তিব্বত সরকারের প্রধান অফিস কার্যালয় এবং দালাই লামার প্রধান বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হত তা অষ্টদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শীতকালীন প্রাসাদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পোত্রাং মার্পো বা রেড প্যালেসে বেশ কয়েকটি চ্যাপেল, পবিত্র মূর্তি এবং আটজন দালাই লামার সমাধি রয়েছে – এটি তিব্বতীয় বৌদ্ধদের জন্য একটি প্রধান তীর্থস্থান হিসাবে গণ্য করা হয়। পোতালার এক হাজারটিরও বেশি কক্ষের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র বলে বিবেচিত হয় চোগিয়াল দ্রুবফুক যা মূল প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ এবং ফাকপা লাখাং যেখানে অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি রয়েছে। দুই লক্ষেরও বেশি মূর্তি এবং প্রায় দশ হাজার বেদী পবিত্র কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত। সৌভাগ্য ক্রমে এই প্রাসাদটি চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় রক্ষা পায়। তিব্বতি জনগণের উপর এই পোতালা প্রাসাদের প্রভাব অপরিসীম।
জোখাং মন্দিরও তিব্বতের সবচেয়ে পবিত্র মন্দিরের মধ্যে অন্যতম। সপ্তম শতাব্দীতে যখন সোংটসান গাম্পো তার রাজধানী লাসাতে স্থানান্তরিত করেছিলেন তখন এটি নির্মিত হয়েছিল। এটি বুদ্ধের একটি মূর্তি স্থাপনা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। নেপাল এবং তাং সাম্রাজ্যের সাথে ভাল প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক তৈরি করার জন্য তুবোর রাজা সোংটসান গাম্পো প্রথমে নেপালের ট্রিটসুন রাজকুমারীকে বিয়ে করেন এবং তারপরে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন তাং রাজবংশের ওয়েনচেং রাজকুমারীকে। দুই রাজকন্যাই যৌতুক হিসাবে তুবোতে বুদ্ধের একটি করে প্রাণবন্ত মূর্তি এনেছিলেন। ৮ বছর বয়সী বুদ্ধের মূর্তিটি যা নেপালের রাজকুমারী এনেছিলেন তা এখন রামোচে মঠে রাখা আছে । জোখাং-এর উত্তরে অবস্থিত রামোচে মন্দিরটিকে জোখাং-এর পরে লাসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং প্রায় একই সময়ে এটি সম্পূর্ণ হয়েছিল। ১২ বছর বয়সী বুদ্ধের জোয়া শাক্যমুনির যে মূর্তিটি তাংয়ের রাজকুমারী তুবোতে নিয়ে এসেছিলেন তা এখন জোখাং মন্দিরে রাখা আছে। কথিত আছে এই মূর্তিটি মূলত ভারতের বোধগয়া মন্দিরে বজ্রাসন হিসাবে স্থাপিত ছিল, যা জোখাংকে আরও বেশি গৌরবান্বিত করেছে। তাই অনুগামীরা জোখাং মন্দিরকে “তিব্বতের বজ্রাসন” বলে উল্লেখ করে।
পরবর্তীকালের শাসকরা এবং দালাই লামারা জোখাং মন্দিরটিকে আরও প্রসারিত ও বিস্তৃত করেছিলেন। জোখাং মন্দিরটি তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের কারণে তিব্বতের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় এবং পবিত্র মঠ। জোখাং মন্দিরটি প্রায় ১৩০০ বছরেরও বেশি পুরানো যেখানে অন্যান্য বিখ্যাত মঠ গুলি যেমন ড্রেপুং মঠ, গ্যান্ডেন মঠের বয়স মাত্র ৬০০ বছর। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসাবে এই মঠ বিখ্যাত এবং তিব্বতের বিভিন্ন অংশ থেকে তীর্থযাত্রীরা দল বেঁধে এখানে আসেন ভগবান বুদ্ধকে প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। একটি প্রবাদ আছে যে “জোখাং মন্দির লাসা তৈরি করেছে”। বর্তমান নাম লাসা জোখাং মন্দিরের আসল নাম রাসা থেকে উদ্ভূত । বলা হয় যে মন্দির নির্মাণের জন্য হাজার হাজার ছাগল (প্রাচীন তিব্বতি ভাষায় ‘রা’) মাটি (প্রাচীন তিব্বতি ভাষায় ‘সা’)বহন করে এনেছিল। এভাবেই প্রথম রাসা নামের উৎপত্তি হয়েছিল। মন্দির নির্মাণের পর থেকে অনেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জোখাং মন্দিরে বুদ্ধের উপাসনা করতে আসেন। সেই সময়কালে তিব্বতে স্থানীয় ধর্ম ‘বনের’ আধিপত্য ছিল। কিন্তু তিব্বতিয় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে বিখ্যাত বাঙালী বৌদ্ধধর্ম প্রচারক অতীশ দীপঙ্কর বিরাট অবদান রেখে গেছেন। তিনি ১০৪৯ সালে জোখাং মন্দিরে বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা দেন।
৬০০ বছরের দীর্ঘ ইতিহাস এবং বিশেষ মর্যাদার কারণে ড্রেপুং মনাস্ট্রি লাসার তিনটি সেরা মঠের মধ্যে প্রধান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বেশ কিছু সাদা দালান ধানের বিশাল স্তূপের মতো বিশাল এলাকা দখল করে আছে। এই কারণেই এই মঠটিকে ড্রেপুং বলা হয় যার অর্থ তিব্বতি ভাষায় “চাল সংগ্রহ করা”। ড্রেপুং মনাস্ট্রি তিন দিকে পাহাড় দ্বারা ঘেরা। ২০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে অবস্থিত ড্রেপুং মনাস্ট্রি তিব্বতের বৃহত্তম মঠ – এখানে একসময় দশ হাজার সন্ন্যাসী থাকতেন। ড্রেপুং মঠে অসংখ্য মূর্তি, ম্যুরাল, বৌদ্ধ ধ্রুপদী সংগ্রহ রয়েছে যা দেখে চক্ষু সার্থক হয় ৷ দ্বিতীয় দালাই লামা ড্রেপুং মঠ নির্মাণের পর থেকে পরবর্তী দালাই লামারা এখানে বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন করেন এবং ধর্মের পাশাপাশি রাজনীতির দায়িত্ব নিতে শুরু করেন। এই কারণে ড্রেপুং মঠ সেই সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং দালাই লামার প্রধান মঠে পরিণত হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম প্রদানের একটি মহান স্থান হিসাবে, ড্রেপুং মঠকে তিব্বতের নালন্দা বলা হত, যেটি ভারতের মহান বৌদ্ধ সন্ন্যাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উল্লেখযোগ্য নাম।
পোতালা প্রাসাদের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত নরবুলিংকাকে “বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান” হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সপ্তম দালাই লামা দ্বারা ১৭৪০ সালে প্রথম নির্মিত হয় নরবুলিংকা, যার অর্থ “ধনের উদ্যান” – এটিকে নরবুলিংকা প্রাসাদ, নরবুলিংকা পার্ক এবং মূল্যবান পাথরের বাগানও বলা হয়। নরবুলিংকা “লাসার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ” হিসাবেও পরিচিত। এটি হিমালয় এবং সারা বিশ্ব থেকে সংগৃহীত ১০০ টিরও বেশি বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের জন্য একটি স্বর্গ রাজ্য। তার চেয়েও বেশি এটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত তিব্বতি বৌদ্ধ ভবনগুলি দেখার জন্য একটি আকর্ষক জায়গা। উপরন্তু এখানকার যাদুঘরে শত শত বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগৃহীত অসংখ্য মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং শৈল্পিক জিনিসের প্রদর্শন দর্শকদের মুগ্ধ করবে।সেই কারণে নরবুলিংকা একাধারে সমৃদ্ধ তিব্বতি সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের সমাহারে তৈরি বাগান এই দুইয়ের যুগল সম্মেলনে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য স্থান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এই প্রাসাদ মধ্যস্থ উদ্যানে মধ্য চীন এবং অন্যান্য দেশ থেকে প্রাপ্ত বিরল প্রজাতির ফুল গাছ, বৈশিষ্ট্যযুক্ত তিব্বতি গাছপালা এবং হিমালয়ের দক্ষিণ ও উত্তরের পাহাড় থেকে সংগৃহীত বিদেশী ফুল গাছ ও ভেষজ উদ্ভিদ দেখে দর্শকদের চক্ষু সার্থক হবে। বিভিন্ন প্রজাতির সুবিশাল সুউচ্চ পাইন এবং সাইপ্রেসের সাথে, নানা ধরণের বিখ্যাত তিব্বতীয় পিওনি এবং হাইড্রেনজা ফুলের সমারোহ মনকে মুগ্ধ করবে। উজ্জ্বল রঙ বিশিষ্ট বিভিন্ন ফুল, নীল আকাশ এবং শান্ত মেঘ লেকের জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে নরবুলিংকাকে সত্যিই তিব্বতি শৈলীর এক অপূর্ব স্বর্গীয় বাগানের রূপ প্রদান করেছে।
এই কদিনে লাসার দ্রষ্টব্য স্থান গুলি দেখা শেষ করে আজকে আমাদের ফেরার পালা । সকাল সকাল লাসা স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। ঠিক সময়েই লাসা থেকে ট্রেন ছাড়ল – পৃথিবীর ছাদ থেকে সমতলে ফেরার যাত্রা শুরু হল। আমরা ছিলাম সফট স্লিপার ক্লাসে – চারটে বার্থের এই কেবিন গুলি বেশ আরামদায়ক, এরোপ্লেনের মত প্রেসারাইজড। এর ভিতর প্রয়োজনে অক্সিজেন নেবারও ব্যাবস্থা আছে। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিরোধক কাঁচের মধ্য দিয়ে বাইরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পড়ছে। দেখছি রুক্ষ পাহাড়ের কোল বেয়ে বয়ে যাচ্ছে লাসা নদী, সবুজ ক্ষেতের জমিতে চাষ হচ্ছে। কোথাও দিগন্ত বিস্তীর্ণ চারণ ভূমিতে চরে বেড়াচ্ছে ইয়াক আর ভেড়ার পাল । মাঝে মাঝে পাহাড়ের কোলে দেখা যাচ্ছে নীল সরোবর – মনে হচ্ছে যেন কেউ নীল কালি ঢেলে দিয়েছে।
তিব্বতের এই রেলপথের প্রযুক্তি এক ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়। এক সুইশ কন্সাল্টিং সংস্থা এই প্রকল্প থেকে চীনাদের সরে আসতে বলেছিল- কিন্তু তাদের কাছে এটা ছিল এক চ্যালেঞ্জ এবং শেষ পর্যন্ত তারা তা পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ করে। শুধু তাই নয়, তাদের পরিকল্পনা হচ্ছে লাসা থেকে এই রেলপথ ভারত, নেপাল এবং ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। কুনলুন পর্বত শ্রেণী ও তিব্বতীয় মালভূমির উপর দিয়ে প্রায় ৭০০ মাইল দীর্ঘ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু , ঠাণ্ডা এবং প্রতিকুল আবওহাওয়ার এই অংশের নির্মাণ কাণ্ড ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ।এখানকার মাটির স্তরের ঠিক নীচে অনেক জায়গায় পারমাফ্রস্ট আছে যা রাতের ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে যায় – কিন্তু গ্রীষ্ম কালে দিনের বেলায় খানিকটা গলে গিয়ে উপরের স্তরকে নরম করে দেয় যা রেলপথের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। সারা বিশ্ব জুড়ে উষ্ণায়নের প্রভাব এখানেও পড়বে এবং পরিস্থিতি জটিল হবার সম্ভাবনা আছে।এখানকার উঁচু নিচু পাহাড়ী জমিতে সব জায়গায় মাটীর উপর দিয়ে রেলপথ টানা সম্ভব নয় । অনেক জায়গায় পাহাড়ের মধ্য দিয়ে টানেল গেছে, কোথাও বা এলিভেটেড ট্র্যাক।
এবারে ট্রেন উপরে উঠছে টের পাচ্ছি-প্যাসেজের মাথায় রাখা অল্টিমিটারের রিডিং লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কামরার মধ্যে অক্সিজেন সাপ্লাই শুরু হয়ে গেছে। দুএকজন মাথা ধরায় কষ্ট পাচ্ছেন – কেউ কেউ প্যাসেজের দেওয়ালে বসানো অক্সিজেন নজলের সামনে দাড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছেন যাতে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। এইপথে সবচেয়ে উঁচু জায়গা হচ্ছে টাঙ্গুলা পাস – যার উচ্চতা প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ফুট। এই স্টেশনের উপর দিয়ে যখন ট্রেন যাচ্ছে তখন মনে হল সত্যিই আমরা on top of the world. এই অনুভুতি আর একবার হয়েছিল যখন লাদাখের খারদুংলা বা চাংলা পাসের উপর দিয়ে গিয়েছিলাম – তাদের উচ্চতা টাঙ্গুলার থেকে প্রায় হাজার ফুট বেশী। এই ওঠার মধ্যে বস্তুতঃ আমাদের কোন কৃতিত্ব নেই –কারন আমরা তো যাচ্ছি ট্রেনে বা গাড়ীতে। কিন্তু যে অভিযাত্রী বা ধর্ম প্রচারকেরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এই বিপদ সংকুল পাহাড় পেরিয়ে অন্য দেশ থেকে এই দেশে এসেছিলেন কৃতিত্ব অবশ্যই তাদের প্রাপ্য।
ট্রলি তে করে খাবার আসছে বিক্রীর জন্য। আমরা লাসা থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসেছিলাম তাই দিয়ে আপাতত চলে যাচ্ছে। কিছু তিব্বতী যাত্রী আমাদের দিকে সাগ্রহে দেখছে। একটি মেয়ে তার বয়স্ক বাবাকে নিয়ে আমাদের কেবিনে ঢুকল। কিন্তু তারা কেউ এক বর্ণ ইংরেজি জানেনা। হাবে ভাবে এবং হাসি মুখে তারা আমাদের সম্ভাষণ জানালো যা বুঝতে আমাদের কোন অসুবিধা হলনা। এর আগেও আমরা দেখেছি যে ভারতীয়দের এরা খুব সম্মান করে এবং ভারতীয়দের সম্পর্কে তিব্বতিদের বিরাট আগ্রহ । কারণটা সহজেই অনুমেয়।
জানলার বাইরে এখন অসাধারণ সব দৃশ্য দেখা যাচ্ছে- ধুধু প্রান্তরের মধ্যে অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা পর্বত শ্রেণী, তাদের বিচিত্র সব রঙ – কোনোটা বাদামি, কোনোটা খয়েরী বা ধুসর আর কতগুলি রজতশুভ্র সাদা বরফে ঢাকা । কোথাও জমে থাকা নদী – কোথাও গ্লেসিয়ার থেকে সৃষ্ট শীর্ণকায় নদী জমা বরফের মধ্যে তার পথ করে নিয়েছে।
দেখতে দেখতে দিনের আলো কমে আসছে । কালো মেঘের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে আকাশ রাঙ্গিয়ে দিয়ে সূর্য অস্তাচলে গেল –সে এক অসাধারণ দৃশ্য। উল্টো দিকের জানলা দিয়ে তখন দেখছি পূব আকাশে লেকের জলের উপরে পূর্ণিমার চাঁদ। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেলে ট্রেনের ভিতর কিছুই করার থাকেনা। রাতের খাওয়ার পর কিছু সময় গল্প গুজব করার পর সবাইকে শুভ রাত্রি জানিয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দরজায় কে যেন ধাক্কা মারছে। খুলে দেখলাম পাশের কামরা থেকে এসে আমাদেরই এক সহযাত্রী বলছেন “জানলা দিয়ে একবার বাইরে দেখুন”। বাইরেটা পুরো অন্ধকার – চাঁদের আলোয় একটা মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে -বাইরে দুই একজন লাইন ম্যান টর্চের আলোয় ট্র্যাক ইন্সপেকশন করছে। এবারে সামনে চোখ পড়তে দেখলাম রেল লাইনের পাশ থেকে সাদা বরফের চাদর কিছুটা সামনে গিয়ে সোজা উঠে গেছে সামনের উঁচু পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত- সে এক অসাধারণ দৃশ্য। আমার ক্যামেরা অত শক্তিশালী নয় যে ঐ স্বল্পালোকে সে ছবি লেন্সবন্দী করবে। তবে আমার মনের ক্যামেরায় সেই ছবি চিরকাল ধরা থাকবে।
পরের দিন ঘুম ভাঙল একটু দেরী করে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি দৃশ্যপট অনেকটাই পালটে গেছে। সেই উঁচু উঁচু পাহাড়, চারণ ভূমি , আর পাহাড়ী নদী অপসৃত – তার জায়গা নিয়েছে অপেক্ষাকৃত নিচু নিচু পাহাড় আর সবুজের সমারোহ । জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের ঢালে ধাপ চাষ হচ্ছে। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা হোয়াং হো বা পীত নদী। এই নদীর উৎপত্তি কুনলুন পর্বতমালা নির্গত গ্লেসিয়ার থেকে।যত নীচে নামছি চোখে পড়ছে ছোটছোট বাড়ী, কল কারখানা – সেই পুরনো পরিচিত চিত্রটা। বিগত দিনগুলি মনে হচ্ছে যেন বাস্তব নয় – স্বপ্নের জগতে ছিলাম। শহরতলী ছাড়িয়ে ট্রেন এখন ঢুকছে বড় বড় শহরে । অনেক লোক উঠছে ও নামছে- সবার মধ্যে একটা ব্যস্ততা। এবারে বাইরে দেখা যাচ্ছে উঁচু উঁচু আকাশ ছোঁয়া বাড়ী গুলি – তার মানে সাংহাই আর বেশী দূরে নেই।
Ki asadharon Lekha o bornona .
Ak kathay anabadyo