স্থান – ফুন্টশোলিং, থিম্পু, ফোবজিকা, ট্রংসা, বুম্থাং, পুনাখা, পারো
সময়- নভেম্বর, ২০১২ যাত্রীগণ – মনিদীপা দাশগুপ্ত ও দেবাশিস দাশগুপ্ত
লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত
সারা রাত ট্রেনে কাটিয়ে শিলিগুড়ি স্টেশন ছেড়ে যখন ‘কাঞ্চন কন্যা’ ডুয়ার্সে প্রবেশ করল তখন মুহূর্তে যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। একদিকে পাহাড় আর অন্য দিকে চা বাগান আর অরণ্য যেন সম্মিলিত ভাবে আমাদের স্বাগত জানাল।
মেঘ মুক্ত নীল আকাশ আর সবুজের প্রাচুর্যের মাঝে এক ঝলমলে সকালে আমরা নামলাম হাসিমারা স্টেশনে। এখান থেকে আমরা গাড়ীতে যাব ফুন্টশোলিং – অর্থাৎ ভুটানের প্রবেশ দ্বার। জয়গাঁ পেরিয়ে ভুটান গেটের ওপারেই বজ্রড্রাগনের দেশ ভুটান।
বিকেলে হোটেলের সামনেই এক বৌদ্ধ মন্দির ঘুরে দেখলাম। প্রকান্ড বড় এক সিলিন্ডার আকৃতির প্রেয়ার হুইল বা প্রার্থনা চক্র – তার গায়ে পালি ভাষায় কিছু লেখা। সবাই সেটা হাতে হাতে ঘোরাচ্ছে। একবার তার আবর্তন সম্পূর্ণ হলে মাথার উপরের রডের ধাক্কায় ঘন্টায় আওয়াজ হচ্ছে ঢং। এই ঢং ঢং আওয়াজ আমরা হোটেল থেকেও শুনতে পাচ্ছিলাম।
সূচীপত্র
কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত
ফুন্টশোলিং- বুদ্ধ মন্দির
মন্দির লাগোয়া পার্কটাও খুব সুন্দর। সেখানে একটা প্ল্যাকার্ডে সুন্দর একটা লেখা পড়লাম। “ সূর্য কিরণ আমরা সকলেই ভালবাসি, আমরা বৃষ্টি চাই না । অথচ আমরা ভুলে যাই যে এই রোদ আর বৃষ্টির সমন্বয়েই তৈরি হয় সুন্দর রামধনু।“ মনে হয় এটাই ভুটানের মর্মবাণী – ভুটানের জনগণের মনের কথা। তাই আপাতদৃষ্টিতে বহু প্রতিকুলতার মধ্যেও তাদের মনের শান্তি বিঘ্নিত হয়নি – কেউ কেড়ে নিতে পারেনি তাদের মুখের হাসি ও সারল্য। GDP বা ‘সার্বিক আভ্যন্তরীণ পণ্য’ নয় – GNH বা ‘সার্বিক জাতীয় সুখ‘ ই হওয়া উচিৎ কোনও দেশের জনগণের সুখে থাকার মাপ কাঠি। এই তত্ত্বই ভুটান শিখিয়েছে সারা বিশ্বকে। এই তত্ত্বের প্রচারক হলেন ভুটানের রাজা স্বয়ং। আমরা জানি উন্নত দেশগুলির GDP আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির GDP র থেকে অনেক এগিয়ে। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে সেখানকার ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রাম বা শহরবাসী নির্বিশেষে সকলেই সুখী সেখানে? যাই হোক এ নিয়ে বিশদ আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আমরা এসেছি বেড়াতে, দেশ দেখতে এবং সেই সঙ্গে সে দেশের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, আধ্যাত্বিক এবং সামাজিক পটভূমিকা যতটা সম্ভব উপলব্ধি করতে।
থিম্পু যাবার পথে পাহাড়ী ঝর্না
সূর্যস্নাত পাহাড় আর পাহাড়ী ঝর্ণাকে সঙ্গী করে শুরু হলো আমাদের পথ চলা। রাস্তার পাশে কমলা লেবু ফলে আছে থরে থরে। পাহাড় বেয়ে কিছুটা ওপরে ওঠার পর চোখে পড়ল চুখা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আর তার সংলগ্ন ছোট্ট জনপদ। যত ওপরে উঠছি ঠান্ডা ক্রমশঃ বাড়ছে ।ফুন্টশোলিং থেকে ঝাড়া হাত পায়ে বেরিয়েছিলাম। এবারে ব্যাগ থেকে একে একে বেরলো সোয়েটার মাফলার ইত্যাদি। পাহাড়ি পথের পাকদন্ডী পেরিয়ে একেবারে অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছি। এখান থেকে চারিদিকের পাহাড়ের সৌন্দর্য অপরূপ – নীচে পাইন আর পাহাড়ি ঝাউয়ের সমারোহ, তার মধ্যে কুয়াশা ঘেরা সবুজ উপত্যকা। চড়াই পেরিয়ে এবারে উৎরাই – কিছুটা নামার পর পেলাম, জাতীয় সড়ক যেটা গেছে সোজা থিম্পুর দিকে। একটু পরেই দেখলাম একটা সুন্দর তোরণ এবং সেটা পেরোতেই দুই নদীর সঙ্গমস্থল। এখান থেকে রাস্তা দুভাগ হয়ে একটা গেছে থিম্পুর দিকে এবং অন্যটা পারো শহরের দিকে। নদী দুটোরও নাম শহরের নামে – থিম্পু চু আর পারো চু ; চু মানে নদী। ভুটানের সর্বত্রই দেখেছি শহরের মুখে সুন্দর তোরণ দ্বার – বিভিন্ন রঙে সুন্দর করে আঁকা। এই নান্দনিক ব্যাপারটা এখানে যারা প্রথমে আসবে তাদের সবাইকে মুগ্ধ করবে। প্রত্যেকটা বাড়ির কার্নিশ, সানশেড সুন্দর ভাবে চিত্রিত এবং সুসজ্জিত। প্রত্যেকটা বাড়ীর গঠনশৈলীও একই রকম। ইট এবং কংক্রিটের জঙ্গল দেশটাকে এখনো গ্রাস করেনি – তাই পাহাড়ের কোলে বা উপত্যকায় এক একটা ছবির মত শহর ও গ্রাম চোখে পড়বে। এখানে পাইন গাছের প্রাচুর্যের জন্য বেশীর ভাগ বাড়ীতেই পাইন কাঠের ব্যবহার বেশী। তার ফলে শীতের সময় বাড়ী গুলো বেশ আরামদায়ক থাকে। দেখতে দেখতে থিম্পুর বাজার এলাকা পেরিয়ে আমরা চলে এলাম হোটেলের সামনে । গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা হাওয়ার দমক শরীর কাঁপিয়ে দিল।
থিম্পুর দ্রষ্টব্য জায়গাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জাতীয় স্মৃতিসৌধ (ন্যাশনাল মেমোরিয়াল ) চোর্তেন, বুদ্ধ পয়েন্ট, লোক-ঐতিহ্য (ফোক্ হেরিটেজ ) মিউজিয়াম, জাতীয় গ্রন্থাগার এবং তাশিচো দ্জং। এখানে একটা কথা বলে রাখি যে ভুটানের যে কোন বড় শহরে আছে দুর্গ বা দ্জং এবং বেশ কিছু মঠ বা লাখাং। দ্জং-এর মধ্যে একদিকে যেমন আছে সরকারী কার্যালয় – অন্য দিকে আছে মন্দির এবং বৌদ্ধ লামা বা সন্ন্যাসীদের আবাস স্থল এবং শাস্ত্রচর্চার স্থান। ধর্মীয় রীতিনীতি, সরকারি কাজকর্ম, ভগবান বুদ্ধ ও দেশের রাজা সবই এখানে একই সুতোয় গাঁথা। তার অর্থ এই নয় যে এখনও তারা মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আবদ্ধ আছে। যদিও কিছু কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অলৌকিক গল্পগাথা প্রায় প্রতিটি স্থানেই প্রচলিত আছে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এই দেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। পাঁচ-ছশো বছরের পুরনো দ্জং এর মধ্যে অবস্থিত এদের প্রতিটি অফিসের কাজকর্ম হয় কম্প্যুটারের সাহায্যে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ই-গভরনেন্সের ফলে প্রশাসনিক কাজকর্মে অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি আমরা যখন ফুন্টশোলিং-এ পারমিট করলাম তখন ছবিসহ আমাদের, গাড়ির এবং ড্রাইভারের সকল বিবরণ স্ক্যান করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের গন্তব্য পথের সকল চেকপোস্টে আগাম পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। পরে যখন আমরা সেইসব জায়গায় গিয়েছি তখন আমাদের সকল কাগজ পত্রের সঙ্গে ওরা কম্প্যুটারে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখেছে। একদিকে প্রচলিত সংস্কার, বিশ্বাস ও ধর্মের মধ্যে নিহিত থাকা এবং অপর দিকে টেকনোলজির প্রতি নির্ভরতা এই দুই বৈপরীত্য নিয়েই আজকের ভুটান।
থিম্পু শহরের অনতিদূরে একটি পাহাড়ের মাথায় বুদ্ধ পয়েন্ট। ভগবান বুদ্ধের ধ্য়ানমগ্ন এই মূর্তিটি শহরের যে কোন জায়গা থেকে চোখে পড়বে।এই জায়গা থেকে থিম্পু শহর , বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ছবির মত লাগে
থিম্পু – বুদ্ধ পয়েন্ট
ফোক্ হেরিটেজ মিউজিয়ামে প্রাচীন গ্রামীণ সভ্যতা, তৎকালীন ব্যবহার্য জিনিপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদির সঙ্গে সম্যক পরিচয় ঘটলো। তাশিচো দ্জং থিম্পু শহর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ওয়াংচু নদীর তীরে অবস্থিত একটি দুর্গ। এটি ১৬১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল এবং এর পর বেশ কয়েকটি সংস্কারের কাজ হয়েছে। এটি বর্তমানে মঠ এবং ভুটান সরকারের কেন্দ্রীয় সচিবালয় উভয় হিসাবেই কাজ করে। মূলতঃ ১২১৬ সালে নির্মিত তাশিচো দ্জংয়ের মূল কাঠামোটি আগুনে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বর্তমান দ্জংয়ের কাঠামোটি নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে। ভবনের সামনে একটি মনোরম গোলাপ বাগান আছে এবং বিল্ডিংয়ের চারপাশে বাগানটিও খুব সুন্দর। উঁচু বিল্ডিংটি থিম্পুর একটি বিশিষ্ট ল্যান্ডমার্ক বিল্ডিং। রাজতন্ত্রের বেশ কয়েকজন আধিকারিকের অফিস ও বাস স্থান এই তাশিচো দ্জং এর মধ্যে অবস্থিত। এটি তাদের গ্রীষ্মকালীন অফিস ও বাসস্থান এবং শীতকালে তারা পুনাখা জংয়ের উদ্দেশ্যে চলে যান। অফিসের দিন থাকায় আমরা দিনের বেলা ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেলামনা। অফিস বন্ধের পর সন্ধেবেলায় গেলাম এবং এই অফিস ও দ্জং দেখে মুগ্ধ হলাম।
প্রত্যেক সরকারী কর্মচারী বা জনসাধারণকে যেকোনো সরকারি অফিস, দ্জং বা মঠে ঢুকতে হলে টুপি খুলে দেশীয় পোশাক পরেই ঢুকতে হবে। এখানকার পুরুষরা হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা পোশাক ‘ঘো’ পরে, সঙ্গে জুতো ও ফুলমোজা – আর মেয়েরা পরে একরকম গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা লম্বা পোশাক –যার নাম ‘কেরা’। জাতীয় মেমোরিয়াল চোর্তেন হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার জায়গা। এখানে বিশ্বাসী ভক্তদের দেখলাম মন্দির প্রদক্ষিণ করছে, একমনে মালা জপছে, মন্ত্রোচ্চারণ করছে এবং নিষ্ঠাভরে জপযন্ত্র ঘুরিয়ে প্রার্থনা করছে এবং তাদের মনোবাসনা জানাচ্ছে ভগবান বুদ্ধকে।
থিম্পু – জাতীয় স্মারক চোর্তেন
এখানে বুদ্ধের বাণী অনেক ছবি ও মূর্তির মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব শান্তি ও প্রগতির প্রতীক এই স্তুপ বা চোর্তেন – যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘বিশ্বাসস্থল’ । ভুটানের তৃতীয় রাজার উদ্দেশ্যে এই স্তূপটি উৎসর্গীকৃত । ফেরার পথে এক হোটেলের পাশে ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য দেখলাম লোকনৃত্যের আসর বসেছে – আমরাও তাতে সামিল হলাম।
থিম্পু – লোক নৃত্যের আসর
থিম্পু ভ্রমণের পরদিন আমাদের যাত্রা ট্রংসার দিকে। পথে পড়ল ‘দোচুলা’ পাস যেখান থেকে চোখে পড়ে হিমালয়ের অনেকগুলি তুষারাবৃত শৃঙ্গ। চারিদিকে শুধু পাইনের বন, আর তার ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের চুড়াগুলি দেখা যাচ্ছে – এক অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য। এখানে আছে ১০৮ টি চোর্তেন যা ভুটানের রানী বানিয়েছিলেন শহিদদের উদ্দেশ্যে। আলফা জঙ্গী যারা আসাম থেকে এসে এখানে ঘাঁটি গেড়েছিল তাদের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু ভুটানি সেনা প্রাণ হারায় – তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই স্তুপ গুলি তৈরি হয়।
দোচুলা পাস
দোচুলা পেরোবার পর ওয়াংডি হয়ে এবারে আমরা যাচ্ছি ফোবজিকা ভ্যালির দিকে। একটা পাহাড়কে পাক দিয়ে আবার নীচে নামতে হবে ফোবজিকার দিকে। পাহাড়ি পথের পাশে ইয়াক চরে বেড়াচ্ছে। ফোটো তুলতে গিয়ে আর একটু হলেই তার শিং এর গুঁতো খেতে হতো। এখান থেকে দেখা গেল ভুটানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘জোমলহরি’। পাহাড়ের ঢালে চরে বেড়াচ্ছে ‘তাকিন’। এই তাকিন হচ্ছে গোরু ও ছাগলের সংকর প্রজাতি। এই প্রাণী এদেশের জাতীয় পশু এবং তিব্বত, ভুটান ও ভারতের অরুণাচল প্রদেশ অঞ্চলে দেখা যায়। এদের মুখটা ছাগলের মতো এবং দেহ ছোট গরুর মতো দেখতে হয়।
পাইন বনাচ্ছাদিত সবুজ উপত্যকার শেষ প্রান্তে ফোবজিকা।এই উপত্যকার সৌন্দর্য নয়নমুগ্ধকর। এখানে ব্ল্যাক নেকড ক্রেন অর্থাৎ কালো গলা বিশিষ্ট সারস দেখতে পাওয়া যায়। এই পাখী এখন বিলুপ্ত প্রজাতির মধ্যে পড়ে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে লাদাখ-তিব্বত থেকে এইসব পাখীরা এই অঞ্চলে আসে। আবার মার্চ মাস নাগাদ ফিরে চলে যায়। এই পরিযায়ী পাখীরা এই অঞ্চলে খুবই প্রিয় এবং সৌভাগ্যের প্রতীক বলে গন্য হয়। এই পাখী আবার ভুটানের জাতীয় পক্ষীও বটে।এই পাখী ফসলের কোনও ক্ষতি করেনা । দলবদ্ধ ভাবে আকাশে চক্কর মেরে যখন এরা উড়তে থাকে তখন স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করে যে তারা সবার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে এবং সে বছরে ভালো ফসল হবে। ফোবজিকায় একটা ভালো মিউজিয়াম এবং অবজারভেশন টাওয়ার আছে – যেখান থেকে এদের ভাল ভাবে নিরীক্ষণ করা যায় এব সেই সঙ্গে এই পাখী সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়।
ফোবজিকা উপত্যকা
ফোবজিকা দেখে এবার আমরা চললাম ট্রংসার পথে। ওখানে রাতের মতো বিশ্রাম নিয়ে পরদিন যাব বুম্থাং। ‘পেলেলা’ পাস পেরিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে পৌঁছলাম ট্রংসায়। ‘মাংডেচু’ নদীর গিরিখাতের ওপরে পাহাড়ের মাথায় ট্রংসা দ্জং। আমাদের হোটেলের ব্যালকনি থেকে এই দ্জং এর সুন্দর ফোটো তোলা হল। এই শহর থেকে কিছু দূরে মাংডেচু নদীর ওপরেই তৈরি হচ্ছে এক বিরাট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প যেখান থেকে প্রায় ৭০০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে ভারতে রপ্তানি করা হবে। এখানে একটা কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা যে ভুটানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এক বিরাট সম্ভাবনাময় প্রকল্প এবং এই বিদ্যুৎ উৎপাদন করেই ভুটান প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এদের নিজেদের চাহিদা মাত্র ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ – বাকিটা প্রায় সবটাই ভারতে রপ্তা্নি হয় যেখানে বিদ্যুতের চাহিদা বিরাট। গতদিনের পথশ্রমে খানিকটা ক্লান্ত ছিলাম, কিন্তু রাতের বিশ্রামের পর এখন চাঙ্গা। সকালেই বেরিয়ে পড়লাম এখানকার বিখ্যাত দ্জং এবং মিউজিয়াম দেখতে। এই সময়টাতে অর্থাৎ নভেম্বর- ডিসেম্বর নাগাদ যদিও ভালো ঠান্ডা থাকে, কিন্তু আবহাওয়া খুবই সুন্দর। আকাশে মেঘের ছিটে ফোঁটাও নেই – রোদ উঠলে ঠাণ্ডাও অনেকটা কমে যায়। ট্রংসা দ্জং সপ্তম শতকে তৈরি হয়েছিল – সেই সময় এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মধ্য ও পূর্ব ভুটানের ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু ছিল এই শহর এবং দুর্গ। ভুটানের প্রথম এবং দ্বিতীয় রাজা এখান থেকেই দেশ শাসন করতেন। এই দ্জং পূর্ব ও পশ্চিম ভুটানের যোগাযোগকারী রাস্তার মধ্যভাগে অবস্থিত এবং এই অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যের জন্য এই দুর্গ থেকে আধিকারিকেরা সর্বক্ষণ যাতায়াতের পথের ওপর নজর রাখতে পারতেন। সেই সময়কার ভুটানের স্থাপত্যের কুশলতারও সাক্ষ্য বহন করছে এই দুর্গ।
ট্রংসা দুর্গের ভিতরে
এই দ্জং-এর পেছনেই ‘তা দ্জং’ বা দ্জং ভিউ টাওয়ারটি নির্মিত হয়েছিল দুর্গের ওপর নজর রাখার জন্য। বর্তমানে এই টাওয়ারটি মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে ভগবান বুদ্ধ এবং বুদ্ধের অবতার গুরু রিনপোচের জীবন এবং ধর্মীয় দিকগুলি বিশ্লেষিত হয়েছে বিভিন্ন মূর্তি ও ছবির প্রদর্শনীর মাধ্যমে।
ট্রংসা দুর্গের বাইরে
দ্জং এবং মিউজিয়াম দেখে বুম্থাং-এর পথে রওয়ানা হলাম। পাহাড়ি সর্পিল পথ এবং দীর্ঘকায় পাইন, ফার এবং ধুপি গাছগুলিকে পাশে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। ‘ওতোংলা’ টপ এবং ‘কিকিলা’ টপ পেরোবার পর এবারে নীচে নামার পালা। স্রোতস্বিনী নদী ‘মুর্চাংফি’ কে পাশে রেখে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর অবশেষে পৌঁছলাম বুম্থাং উপত্যকায়।
বুম্থাং শহরের মাথায় রয়েছে ‘জাকার দ্জং’ বা শ্বেত পক্ষীর দুর্গ। কথিত আছে লামারা যখন এই দুর্গ এবং বৌদ্ধ বিহারের স্থান নির্বাচনের জন্য এখানে জমায়েত হয়েছিলেন তখন একটি বড় সাদা পাখি হঠাৎই উড়ে এসে এই পাহাড়ের মাথায় এসে বসেছিল। এটিকে তাঁরা একটি শুভ লক্ষণ মনে করেন এবং এখানেই মনাস্ট্রি স্থাপন করা ঠিক হয়। বর্তমানে এখানে এই অঞ্চলের বা ‘দ্জংখাগের’ সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্ম হয় এবং এটা হচ্ছে ট্রংসার সন্ন্যাসীদের গ্রীষ্মকালীন আবাস স্থল।
জাকার দ্জং -বুম্থাং
অতীতে এই দুর্গ পুর্বপ্রদেশ বা দ্জংখাগগুলির সুরক্ষার ব্যাপারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ভুটানের প্রথম রাজা এখানেই সিংহাসনে বসেন। শহরের দ্রষ্টব্য দ্জং ও লাখাংগুলি দেখার পর আমরা শহর ছাড়িয়ে কিছু দূরে গেলাম ‘মেম্বারৎসো’ বা জ্বলন্ত সরোবর দেখতে।তাং চু অর্থাৎ তাং নদী উপর থেকে ধাপে ধাপে নেমে এখানে পাহাড়ের খাঁজে কিছুটা সমতল জায়গায় এই জলাশয়ের সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় লোকেদের কাছে এটি অতি পবিত্র এক স্থান। কথিত আছে বৌদ্ধ ধর্মগুরু পেমা লিংপা অবিশ্বাসী কিছু স্থানীয় অধিবাসীর সামনে একটি জ্বলন্ত ঘিয়ের প্রদীপ হাতে নিয়ে এই জলাশয়ে ডুব দিয়ে প্রাচীন তিব্বতি ধর্মগ্রন্থ, ধনসামগ্রী এবং মূর্তি উদ্ধার করেন যা গুরু রিংপোচে রেখে গিয়েছিলেন এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তখনও তাঁর হাতে ধরা প্রদীপটি জ্বলন্ত ছিল। রাস্তা থেকে কিছুটা নামতে হয় এই স্থানে পৌঁছোবার জন্য। আমরা সাবধানে পাথরের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে বেশ কিছুটা নামবার পরে দেখলাম নীচে রঙ-বেরঙের রঙ্গিন কাগজের তৈরি পতাকা ঝুলছে আর পাহাড়ের গায়ে গুহার মধ্যে খোদিত মূর্তি আর তার পাশে সারি সারি বড়ির মতো দেখতে নৈবেদ্য যাকে স্থানীয় লোকেরা বলে ‘তোরমা’। পাশেই ঘিয়ের প্রদীপ আর ধুপ কাঠি জ্বলছে। আরও কিছুটা নামবার পর একটা ছোটো সাঁকো পেরিয়ে গেলাম নদীর কাছে। খুব খরস্রোতা নদী – একটু অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা অনিবার্য। ছোট্টো জলাশয় সৃষ্টি করে নদী আপন বেগে পাগলপারা হয়ে নীচের দিকে ধেয়ে চলেছে দুরন্ত ঘূর্ণির পাক দিয়ে এঁকেবেঁকে।
শহরে ফেরার পথে নীচের দৃশ্যটি খুবই মনোরম। উপরে নীল আকাশ, এক পাশে সবুজ অরণ্য ও অন্য দিকে ছবির মতো শহর আর নীচের উপত্যকার মধ্য দিয়ে নুড়ি বিছানো পথ ধরে তির তির করে বয়ে চলা নদী – যেন কোন অদৃশ্য চিত্রকরের হাতে আঁকা অসাধারণ এক ছবির উপস্থাপনা করেছে। উপর থেকে বুম্থাং বিমান বন্দরের রানওয়ে দেখা যাচ্ছে। পাশে দেখলাম এক জায়গায় তীরন্দাজীর প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে তীরন্দাজী ভুটানে খুবই জনপ্রিয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে এর টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়।
বুম্থাং বিমান বন্দরের কাছে
বুম্থাং শহর দর্শন শেষে পরের দিন আমরা চললাম ওয়াংডি শহরের দিকে। আবার দীর্ঘ পথ চলা – ওতোংলা, কিকিলা, ট্রংসা পেরিয়ে সেই একই পথে ফেরা। ওতোংলা টপের পাশে রাস্তার ধারে পাইন ও ফার গাছের জঙ্গলের মাথায় সাদা তুষারের আবরণ । বুঝলাম শীতের আর বেশী দেরি নেই। ওয়াংডিতে যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল হয়ে গেছে। হোটেলের ব্যালকনি থেকে দেখা যায় নদী এঁকেবেঁকে চলেছে পূব থেকে পশ্চিম দিকে। নদীর পারে সদ্য তৈরি হওয়া নতুন ওয়াংডি শহর। পরদিনের গন্তব্যস্থল পুনাখা দ্জং। থিম্পুর পর এটাই বৃহত্তম দ্জং ভুটানে। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পুনাখা ছিল ভুটানের রাজধানী। দ্জং-এ যাবার পথে রাস্তার ধারে একটা পার্ক থেকে দেখলাম দুই নদী ‘ফোচু’ (পুরুষ নদী) আর ‘মোচু’ (নারী নদী)র সঙ্গমস্থল। এই স্থানটিতে প্রাকৃতিক পরিবেশ অতি মনোরম। স্কুলের ছেলে মেয়েরা পার্কের মধ্যে এই সুন্দর পরিবেশের মধ্যে পড়াশুনা করছে। তাই তাদের পড়ার বিঘ্ন না ঘটিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম নদীর। নদীর সঙ্গম স্থলে দুটি জলের ধারার দু রকম রঙ। এই ‘মোচু’ নদী আরো নীচে নেমে নাম নিয়েছে ‘সংকোশ’। দ্জং-এ পৌঁছে নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে পরিচয় পত্র দেখিয়ে দ্জং-এর ভিতরে প্রবেশ করলাম। দ্জং-এর ভিতরে টুপি ও কোট পরে প্রবেশ নিষেধ। এই দ্জং অনেক বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন রাজা রানীর বিবাহ,, রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান ইত্যাদির সাক্ষী।
পুনাখা দ্জং
আমরা যখন মন্দিরের অভ্যন্তরে পৌঁছলাম তখন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং তাঁর ছাত্ররা ধর্মীয় পাঠ এবং অধ্যয়নের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কিছুক্ষণ বাদে শাস্ত্র পাঠ শেষ হল। আমরা সামনে গিয়ে ভগবান বুদ্ধ, গুরু পদ্মসম্ভব এবং অন্যান্য মূর্তি দর্শন করলাম। দ্জং-এর ভিতরে ও বাইরে কাঠের ওপর খোদাই করা কারুকার্যগুলি অতি সুন্দর। বাইরে এসে দেখি ভক্তরা মাঝখানের চত্বরের মধ্যে মঞ্চের উপর পুজোর আয়োজন করছে। ভেতর থেকে গুরুগম্ভীর ঢাকের মত আওয়াজ ও শিঙ্গার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সামনে যজ্ঞকুণ্ডে আগুন জ্বালানো হয়েছে। ভেতরে পূজোর আয়োজন চলছে।
পুনাখা দ্জং-এর যজ্ঞানুষ্ঠান
পুনাখা দ্জং দেখে আমরা পরের গন্তব্য স্থলের দিকে এগিয়ে চললাম। কিছুটা উপরে উঠে আর এক মনাস্টেরি বা মঠ – বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীদের জন্য।এই জায়গাটার নাম ওলাখা আর মঠের নাম সাংচেন দোর্জি লেন্দ্রুপ মনাস্টেরি ও লাখাং। এখানে সন্ন্যাসিনীদের ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও হাতে কলমে কাজ যেমন সেলাই, এম্ব্রয়ডারি, থাঙ্কা পেন্টিং ইত্যাদিও শেখার ব্যবস্থা আছে। শুনলাম ভুটান রাজের দাদু এই মনাস্টেরি তৈরি করেছেন এবং এর সকল ব্যয় ভার তিনিই বহন করেন।
সাঞ্চে রিম্পোচে লেন্দ্রুপ মঠ
মঠের বাইরে কালো মার্বেলে তৈরি বিভিন্ন মূর্তি চারিদিক ঘিরে। মন্দিরের ভিতরে কাঠের তৈরি পিলার, আরচ, দেওয়ালে বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙে আঁকা ভগবান বুদ্ধের জীবন অবলম্বনে আঁকা চিত্রাবলী এক অন্য মাত্রা দিয়েছে মন্দিরের অন্দর সজ্জায়। বুদ্ধ মূর্তির বিপরীতে রাজার সিংহাসন –রাজা মন্দিরে এলে ঐ সিংহাসনে বসেন। মন্দিরের বাইরের চত্বর থেকে আশেপাশের উপত্যকা, নদী এবং দ্জং অপূর্ব লাগছিল।
মঠের বাইরে থেকে দেখা দৃশ্য
এবার আমাদের গন্তব্যস্থল পারো। আবার সেই দোচুলা পাস, অনেক আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে, থিম্পু শহরকে পাশে রেখে, ‘পারোচু’ নদীকে পথের সঙ্গী করে বেশ কিছুটা যাবার পর গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম। শহরে ঢোকার পথে নীচে দেখলাম পারো বিমানবন্দর। ওপর থেকে বিমান বন্দর ও পারো চু র দৃশ্য অসাধারণ লাগল। অবশেষে যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল। পরদিন সকালে গেলাম মিউজিয়াম। ভুমিকম্পের ফলে মিউজিয়ামটি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখন সেখানকার বহু সামগ্রী পার্শ্ববর্তী একটি ভবনে স্থানান্তরিত করে সেখানেই অস্থায়ী মিউজিয়ামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন থাঙ্কা, মুখোস, অস্ত্রশস্ত্র, প্রাচীন ব্যবহৃত জিনিষপত্র ইত্যাদি।
পারো শহরের দৃশ্য
পারোই ছিল আমাদের ভুটানের শেষ গন্তব্যস্থল।এবারে ঘরে ফেরার পালা। এই শান্তির আর অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্য থেকে আবার কোলাহলের জগতে ফিরতে হবে। পেছনে ফেলে আসব এক সবপেয়েছির দেশ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও এখানে রাজার প্রভাব অপরিসীম। তিনি ভগবানের মতই দেশে পুজিত হন। সবাই রাজার কাজে খুশি – তাই সবার মুখে হাসি।
ভুটানের প্রত্যেকটি দর্শনীয় স্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লেখাটিতে তুলে ধরা হয়েছে। একটি অনবদ্য প্রয়াস। পড়ে মনে হচ্ছিল প্রত্যেকটি জায়গা আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। ভুটান সত্যিই ঈশ্বরের অনবদ্য সৃষ্টি। সে দেশের মানুষ ‘সার্বিক জাতীয় সুখ‘ কে তাদের মুখ্য মনে করে সেটা লেখাটিতে উল্লিখিত আছে যা আমাকে নতুন ভাবে ভাবতে শেখাল। আরো লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।