© লেখা ও ছবি – অরূপ দাশগুপ্ত
অরিত্ররা তিন ভাই। অরিত্র ছোট। দাদারা দুজনে পড়াশোনায় তুখোড় হলেও অরিত্র বরাবর একটু অমনোযোগী আর ফাঁকিবাজধরনের।স্কুলে কোনোদিনই খুব একটা ভালো রেজাল্ট করতে পারতো না অরিত্র। সব আশা ত্যাগ করে অরিত্রর আর কিছু হবে না ধরে নিয়ে অরিত্রর বাবা ওকে হায়ারসেকেন্ডারীর পর কম্পিউটার নিয়ে পড়তে বললেন। আশা, যদি পাশ করে অন্তত কোথাও একটা চাকরী পায়।
অরিত্রর কেরিয়ার কিন্তু মোটেই খারাপ হয়নি। সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় বি এস সির পর এম সি এ করে শেষে এম টেক কমপ্লিট করে অরিত্র। প্রথমে বছরখানেক দুএকটা কলেজে পার্টটাইম পড়াবার পর স্লেট কোয়ালিফাই করে এখন উত্তর কলকাতায় একটা কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। মাস তিনেক হলো অরিত্র বিয়েও করেছে।
অরিত্রর বউটি, টোড়ি, ভারী শান্ত! নিজেও স্লেট কোয়ালিফাই করে একটা কলেজে ইতিহাসের ফুলটাইম টিচার। তাসত্বেও সবসময় কেমন একটা সুগৃহিনী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা টোড়ির।
কলেজে ছুটি না পাওয়ায় এখনও অরিত্ররা কোথাও বেড়াতেও যেতে পারেনি।
অরিত্রর কলেজের বন্ধু ঋজু, একসঙ্গে এম টেক করেছিলো। এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকে। মাঝে একদিন বউ নিয়ে এসেছিল।
তিস্তা, ঋজুর বউ, ভারী মিষ্টি মেয়েটি। লম্বা ছিপছিপে চেহারা, চোখেমুখে কথা বলে। ঋজুও বেশ সপ্রতিভ আর খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। আর ভীষণ আড্ডাবাজ।
অরিত্ররা বসে আড্ডা মারছে অথচ টোড়ি নেই, সে ব্যাস্ত অতিথি আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করতে।
তিস্তা কিন্তু বেশ মনক্ষুন্ন হলো, অরিত্রকে তো বলেই ফেললো “কি গো অরিত্রদা, নতুন বউটাকে খাটিয়েই মারবে নাকি! তোমাদের রান্নাঘর কোনদিকে! আমি যাচ্ছি হেল্প করতে।”
বলতে না বলতেই টোড়ি প্লেট সাজিয়ে সব নিয়ে এলো।
ফিস ফ্রাই, লুচি, পাঁঠার মাংস, তিন রকমের মিষ্টি আর চা। তিস্তা টোড়ির হাত ধরে জোর করে বসিয়ে দিলো, “আর এখান থেকে একটুও নড়বেনা।”
“আচ্ছা খাবার জলটা তো এনে দিই!” টোড়ি হেসে বললো।
টোড়িরা বিয়ের পর এখনো কোথাও বেড়াতে যাইনি শুনে তিস্তা আরেক চোট বকা দিলো অরিত্রকে।
শেষে ঠিক হলো ওরা চারজনে পুজোর সময় একসাথে বেড়াতে হবে। পুজোর সময়টায় এমন ওয়েদার থাকে যে যেকোনো ধরেনের জায়গাতেই যাওয়া যায়, সে জঙ্গলই হোক, পাহাড়ই হোক কিংবা সমুদ্রের তীরেই হোক। সেক্ষেত্রে পাহাড়ের জঙ্গলে অথবা সমুদ্রের তীরে কোনো জঙ্গলে যাওয়া যেতে পারে। অনেক তর্কাতরকির পর তিস্তা বললো “শ্রীলঙ্কা যাওয়া হবে, আর কোনো আলোচনা হবে না। আমি কালকেই রাতের মধ্যে আইটিনেরারি করে পাঠাচ্ছি, অরিত্রদা তুমি আর ঋজু বাজেট ঠিক করে ফ্যালো।”
তিস্তার আইটিনেরারিটা বেশ ভালই। কলম্বোর থেকে গালে হয়ে ইয়াল ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে দুদিন থেকে ন্যুয়ারা এলিয়াতে দুদিন! ন্যুয়ারা এলিয়া থেকে ট্রেনে কলম্বো। শেষে কলম্বোতে একদিন থেকে বাড়ি ফেরা। মোটামুটি শ্রীলঙ্কার একটা সার্কুলার ট্রিপ। ঋজুর অফিসের একজনের চেনা এক ট্রাভেল এজেন্টের সাথে কথা হলো। সে কলম্বো থেকে ন্যুয়ারা এলিয়া পর্যন্ত ছদিনের জন্যে একটা নাইন সিটার গাড়ী দেবে। অরিত্ররা কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে যাবে সেখান থেকে চারজনে একসাথে শ্রীলঙ্কা।
সবকিছুই প্ল্যান মাফিকই হলো। প্ল্যান অনুযায়ী সঠিক দিনেঅরিত্ররা সবাই ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে মিট করে ইন্ডিগোর ফ্লাইটে কলম্বো পৌঁছালো।
কলম্বো শহরটা আর পাঁচটা ভারতীয় শহরের মতই। শহরের একধারে ভারত মহাসাগর। স্থানীয় লোকজন একটু শান্ত প্রকৃতির। সেদিন সন্ধ্যায় ওরা একটা অটো নিয়ে সমুদ্রের তীরে কলম্বো প্ল্যান রোডে গেলো। ভারী সুন্দর জায়গাটা। বিচ বলতে সেরকম কিছু নেই, অনেকটা মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভের মতো। সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা বেশ জমজমাট জায়গায় পৌঁছালো। লাইন দিয়ে শুধুই পাঁচতারা হোটেল আর রেস্টুরেন্ট, ততক্ষণে রাত আটটা বেজে গেছে, ঋজু বললো “এবার ফিরতে হয়।”
তিস্তা আর টোড়ির আবদারে পথেই শিন ঝু নামে একটা চাইনীজ রেস্টুরেন্টে খেয়ে ওরা হোটেলে ফিরে এলো। পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে, সোজা ইয়ালা।
ইয়ালা যাওয়ার রাস্তাটা দারুন ভালো। ড্রাইভার দুলাঞ্জনা জানালো তামিলদের সাথে যুদ্ধের পরই এইসব রাস্তা আবার নতুন করে হয়েছে। এখন নাকি শ্রীলঙ্কার সরকার ইনফ্রাস্ট্রাকচারের পেছনে প্রচুর খরচ করছে।
ইয়ালা পৌঁছুতে দুপুর হয়ে গেলো। চেক ইন্ করেই সকলে হোটেলের রেস্টুরেন্টে খেতে দৌড়ালো। তখনও বুফে চালু ছিল। শ্রীলঙ্কানরা খুব মাছ খায়। ভাত, চিংড়ি আর একটা অন্য সিফিশের প্রিপারেশন, এই দিয়ে মোটামুটি ভালোই হল লাঞ্চটা। হোটেলটা বেশ ভালো। ওরা পাশাপাশিই ঘর পেয়েছে। দুটো ঘড়ই সিভিউ। ব্যালকনি দিয়ে দুরে ভারত মহাসাগর দ্যাখ যাচ্ছে। খুব হাওয়া। তবে হোটেল আর সমুদ্রের মধ্যে একটা বেশ বড় খাঁড়ি। খুব বেশি গাছপালা দেখা যাচ্ছে না। ওদের ঘর গুলো পশ্চিমে। তাই বারান্দায় বেশ কড়া রোদ। জার্নির ধকল বেশ ভালই পড়েছে শরীরের ওপর। লাঞ্চ করে এসে কেউ আর আড্ডার কথা উচ্চারণও করলো না।সবাই যে যার ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিলো।
ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের আওয়াজে। টোড়ি দরজা খুলে দ্যাখে তিস্তা আর ঋজু। ঋজু বললো “বারান্দার দরজাটা খোলো, একবার দ্যাখো!”
সবাই মিলে হুড়মুড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দ্যাখে সে এক অপরূপ দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় শুধুই লাল, হলুদ আর কমলা রঙের মেলা। সূর্য অস্ত গেলেও যাওয়ার আগে চারপাশকে রঙিন করে দিয়ে গেছে। চারদিকে একটা খুশি খুশি ভাব, দলে দলে পাখি নানান রকম প্যাটার্নে নিজেরা দল বেঁধে উড়ে যাচ্ছে, হয়তো নিজেদের বাসায় কিংবা কোনো নতুন দেশে! কি যেন বলতে বলতে উড়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে একটু একটু সন্ধ্যা গাঢ় হতে থাকলো। এরই মাঝে টোড়ি গেয়ে উঠলো “সন্ধ্যা হল গো…. ও মা..” ! সব্বাই চুপ। গান শেষ হলেও কেউ কোনো কথা বললো না! বেশ ভালো গায় টোড়ি।
সেই কবে গান শেখা ছেড়ে দিয়েছে তবুও তিস্তা শ্রী রাগে একটা ঠুমরী ধরলো। দমে একটু কষ্ট হলেও অসাধারন একটা পরিবেশ তৈরি হলো।
ততক্ষণে চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে, তবুও জলে রিফ্লেক্ট হয়ে একটা হালকা আলোর আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। ধীরে ধীরে আকাশ জুড়ে এক তারার মেলা বসলো। এতো তারা একসাথে ওরা কেউ আগে কখনো দ্যাখেনি। বিশাল একটা ব্যাপ্তি আকাশের। টোড়ি আবার ধরলো –
“বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ॥
বাজে অসীম নভোমাঝে অনাদি রব,
জাগে অগণ্য রবিচন্দ্রতারা ॥
একক অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডরাজ্যে
পরম-এক সেই রাজরাজেন্দ্র রাজে।
বিস্মিত নিমেষহত বিশ্ব চরণে বিনত,
লক্ষশত ভক্তচিত বাক্যহারা ॥”
“সত্যি কি অসাধারণ কথা না! এখানে না এলে বোধহয় এর মানে উপলব্ধিই করতে পারতাম না।” ঋজু ফিসফিস ক’রে বলে উঠলো।
ইতিমধ্যে ইন্টারকমে খবর এলো দুলঞ্জনা কথা বলতে চায়, লবিতে অপেক্ষা ক’রছে। ঋজুর নীচে লবিতে গিয়ে দুলাঞ্জনার সাথে কথা বলে এলো, কাল জঙ্গলের সাফারির জন্যে গাড়ী ঠিক হয়ে গেছে। কোনো বাধা সময় নেই, লেপার্ড দেখতে যতক্ষন লাগে। তবে মিনিমাম পাঁচ ঘণ্টা। আর লেপার্ড না দেখাতে পারলে ৫০% ডিসকাউন্ট। সকাল ছটায় গেট খোলে। তাই সাড়ে পাঁচটার মধ্যে গেটে পৌঁছাতে হবে।
এদিকে ইয়ালার জঙ্গলে চল্লিশটারও বেশি লেপার্ড আছে শুনে তিস্তা তো ভীষণ এক্সসাইটেড! বলে উঠলো “তাহলে তো দ্যাখা যাবেই বলো? আমার তো ভেবেই কেমন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, আমরা যাচ্ছি আর একটু দূরেই গাছের ডালে উনি বসে আছেন! উরিব্বাস!”
“অত সহজ নয় ম্যাডাম! কষ্ট করতে হবে। ওনারা হলেন উচ্চবর্ণের ভিন্ন জাত। খুব প্রয়োজন ছাড়া জনসমক্ষে আসেন না। তার জন্যে চাই ধৈর্য্য আর প্রার্থনা।” ঋজু বললো।
“আর তাছাড়া ইয়ালার জঙ্গলের এরিয়া হলো প্রায় ৩৮০ স্কোয়ার মাইল। ফলে এতো বড়ো এরিয়াতে ৪০ টা লেপার্ড! দেখতে পাওয়া কঠিন তার ওপর সব অঞ্চলে সবাইকে যেতেও দেওয়া হয় না। তবে লেপার্ড ছাড়া আরও ৪০ রকমের ম্যামালস আছে। তার মধ্যে হাতি আর কুমীরও প্রচুর। এছাড়া আছে নানান ধরনের পাখি। ” ঋজু বুঝিয়ে বললো।
সেদিন ডিনারে অন্যান্য পদের সাথে কুকুল মাস কারি মানে মুরগীর ঝোল আর পারিপ্পু অর্থাৎ মুসুর ডাল ফ্রাইও ছিলো।
পরদিন ভোরবেলা পৌনে পাঁচটায় গাইড সমেত সাফারির গাড়ী এসে হাজির। গাইডের নাম বিজয়রত্নে, সে বললো তাকে বিজয় বলে ডাকতে। খাঁড়ির রাস্তা পার হয়ে গাড়ী হাইওয়েতে পড়লো। মিনিট দশেক যাওয়ার পরেই ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কের গেট এসে গেলো। এরমধ্যেই সাতটা গাড়ী এসে গেছে, অরিত্ররা আট নম্বর। গেটের ওপরে লেখা কাতাগামুয়া গেট। ঋজু নেমে গিয়ে কফি কিনে আনলো।
ঠিক ছটার সময় গেট খুললো। প্রত্যেকটা গাড়ির মধ্যে একটু গ্যাপ দিয়ে ভিতরে ঢোকাচ্ছে যাতে গাড়িগুলো একসাথে ভির না করে। এক এক করে ঢোকার পরে ঋজুদের টার্ন এলো। সবাই দারুন এক্সসাইটেড। গেট দিয়ে ঢুকে একটু গেলেই একটা তিন রাস্তার মোড়, বিজয় ওয়াকিটকিতে কার সাথে একটা কথা বলে ড্রাইভার কে বললো বাঁদিকে যেতে।
জঙ্গলটা একটু অন্যরকম। দুপাশে কাঁটাগাছের ঝোঁপ। একটু ভেতরে ঢুকতেই হঠাৎ ড্রাইভার গাড়িটা থামিয়ে দিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো। ফিসফিস করে বললো বাঁদিকে দেখতে।বাঁদিকে একটু দুর থেকে একটা হাতি রাস্তার দিকে ছুটে আসছে। ঋজুরা ছবি তুললেও তিস্তাদের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। প্রচণ্ড আওয়াজ করে হাতিটা কুড়ি পঁচিশ ফুট দূরে এসে গাড়ির দিকে মুখ করে থমকে গিয়ে অনেক ধুলো উড়িয়ে দাঁড়ালো। বিজয় বললো হাতিটা কাউকে খুঁজছে, আমাদের কিছু করবে না। কোনো কিছু গ্রাহ্য না করে হাতি যখন ওদের গাড়ির দিকে এগোতে থাকলো তখন ড্রাইভার আর কোনো কথা না শুনে গাড়ী স্টার্ট দিয়ে পিছনের দিকে যেতে আরম্ভ করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেলো হাতিটার টার্গেট ঋজুরা নয় অন্য কিছু। আর একটু গাড়ির দিকে এগিয়ে হঠাৎ কি বুঝে পিছন ফিরে আবার যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই সে মিলিয়ে গেলো। ওরা সবাই কেমন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। টোড়ি তখনও চোখ বন্ধ করে দুকান চেপে বসে আছে দেখে তিস্তা বললো “টোড়ি তাকাও! তোমার প্রিন্সিপাল স্যার চলে গেছেন!” সবাই হো হো করে হেসে উঠলে টোড়িও একটু নরম্যাল হলো।
ভারী সুন্দর জঙ্গলটা। সামনে যতদূর চোখ যায় সোজা মাটির রাস্তা। মাঝে মধ্যে একটু ফাঁকা জমি আর তার ধার দিয়ে বড়ো বড়ো গাছ। আর পাখির তো কোনো শেষ নেই। কতরকম যে পাখির ডাক, বলে শেষ করা যাবে না। অরিত্রদের কথা মতো মাঝে মধ্যেই গাড়ী দাঁড়াচ্ছে ছবি তোলার জন্যে। এইরকমই একটা ফাঁকা জমি, তার পাশে একটা পুকুরের ধারে এসে গাড়িটা দাঁড় করালো বিজয়। পুকুরের ঠিক উল্টোদিকে কাদার মধ্যে অন্তত তিনটে বেশ বড় সাইজের কুমীর শুয়ে আছে। মিনিটখানেক দাঁড়াতে হঠাৎ ঝপাৎ করে আওয়াজ, দ্যাখে, ওরা পুকুরের যেদিকে দাঁড়িয়ে সেদিকেই ওদের থেকে ফুট চল্লিশেক দুরে একটা বিশাল কুমির জল থেকে একটা বড়ো মাছ মুখে ধরে রেখেছে। কুমিরের শরীরটা বাইরে হলেও মুখটা জলে আর মাছটা ছটফট করছে বলেই এইরকম আওয়াজ। অরিত্র বলে উঠলো “উফ্ দারুন!” বিজয় ড্রাইভারকে বলে গাড়িটা আর একটু কাছে নিয়ে গেলো। কুমিরের মাছ খাওয়া দেখে ঋজুরা আবার এগোতে শুরু করলো। গাড়ী যখন এগোচ্ছে তিস্তা শুধুই এপাশ ওপাশে গাছের ওপরে লেপার্ড খুঁজছে। একটু দুরেই একটা জলার সামনে একদল হরিণ। অন্তত কুড়িটা তো হবেই। কেউ জল খাচ্ছে কেউ বা খাচ্ছে ঘাস। টোড়ি খুব চিন্তিত হয়ে বললো “কি বোকা না হরিণগুলো! আচ্ছা যদি এই জলে কুমির থাকে? তাহলে তো এক কামড়ে খেয়ে ফেলবে!”
“এটাই তো জঙ্গলের মজা। এখানে কেউ এক গ্রামও বাড়তি খাবার খায় না। কুমিরের প্রয়োজন না থাকলে ওর পাশে একটা নাদুস নুদুস হরিণ বসে থাকলেও খাবে না। ওরা আমাদের মতন একদমই লোভী নয়।” ঋজু বোঝালো। “আর তার থেকেও বড় কথা হলো ওদের নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং। বাঘ যখন জঙ্গলের কোনো জায়গা দিয়ে যায়, ওপর থেকে দেখে বাঁদর, পাখি সবাই মিলে চেঁচিয়ে নিচে হরিণদের সাবধান করে দ্যায়। এই মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জন্যেই অত সাংঘাতিক সুনামিতে একটা মাছ ছাড়া এই পুরো ইয়ালার জঙ্গলে একটা পশু পক্ষীও মরেনি। অথচ আড়াইশো জন টুরিস্ট মারা গেছিল। পাখিরা আর্থের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের চেঞ্জ থেকে আগেই বুঝেছিলো, সুনামি শুরু হবার আগে ভূমিকম্পের ট্রেমারে হাতি, কুমীর এরা সবাই আগেই বুঝতে পেরেছিলো কিছু একটা ঘটবে। কেউ চেঁচিয়ে, কেউ পা দাপিয়ে, কেউবা আবার অস্বাভাবিক আচরণ করে বাকিদের অ্যালার্ট করে দিয়েছিলো। একটা হাতির পা দাপানির ট্রেমার অন্য একটা হাতি চল্লিশ কিলোমিটার দুর পর্যন্ত টের পায়। তাই এরাই সামাজিক প্রাণী, আমরা নই। কি সাংঘাতিক কোঅর্ডিনেশন ভাবাই যায় না। আবার প্রয়োজনে এরাই একে অন্যকে শিকার করে। কি অদ্ভুত না!”
গাইড গাড়িটা থামাতে বললো। সামনে সোজা ডানদিকে একটা পাথরের টিলা দেখিয়ে বললো “হিউম্যান ফেস রক”! সত্যি দেখে মনে হচ্ছে একটা মানুষের মুখ। ওটাই পুরো টিলাটা। টোড়ি দেখে বলে উঠলো “আদিম মানুষের মত।” আর ঠিক হিউম্যান ফেসের মাথায় চার পাঁচটা হনুমান ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে পিঠ চুলকাচ্ছে। অরিত্ররা যখন জঙ্গলের এইসব দৃশ্য উপভোগ করছে, বিজয় কিন্তু সমানে ওয়াকিটকিতে অন্য গাইডদের সাথে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছে কোনদিকে গেলে লেপার্ড দেখা যাবে। আরো কিছুক্ষন যাওয়ার পরে একটা গাছের তলায় এসে গাড়িটা থামলো। সামনে ডানদিকে একটু নেমে বিস্তীর্ণ একটা ফাঁকা জমি। দুরে ভারত মহাসাগর দ্যাখ যাচ্ছে। জমির মাঝে একটা অলমোস্ট শুকিয়ে যাওয়া পুকুর। পুকুরের ওপারে একদঙ্গল বাইসন। আর তাদের পাশেই এক গ্যাং হরিণ চড়ে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে। অপূর্ব দৃশ্য। ঋজুরা এই জায়গাটাতে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধুই পাখির ডাক আর তারসাথে দুর থেকে ভেসে আসা হালকা সমুদ্রের ঢেউএর আছড়ে পড়ার আওয়াজ। এই নিস্তব্ধতায় একটা অন্যরকম শান্তি আছে। এবার বিজয় বাঁদিকে ঢুকে অন্য রাস্তা ধরলো।
এদিকটা একটু অন্যরকম। আগের থেকে অনেক বেশি সবুজ। খুব সুরেলা একটা পাখির ডাক শুনে টোড়ি বিজয়কে জিজ্ঞাসা করলো কি পাখি! “দ্যাট ইজ ডার্ক ক্যাপড বুলবুল ম্যাডাম!” বিজয় জানালো। ভারী সুন্দর ডাকটা। আর একটু এগোতেই তিস্তা প্রায় চেঁচিয়েই গাড়িটা থামানো করালো। সামনের গাছের ডালের দিকে ইঙ্গিত করে দেখতে বললো। সবাই তো ভাবলো লেপার্ড! না দুটো ধনেশ পাখি। টোড়ি তো দেখে মুগ্ধ। কি সুন্দর ঠোঁটের রঙ। বেশ বড় পাখি দুটো। মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত দুফুট তো হবেই।
তখন প্রায় দশটা বাজে। অরিত্র জিজ্ঞাসা করলো কাছে কোথাও চা পাওয়া যাবে কিনা! সাথে যেন টয়লেটও থাকে। বিজয় কাছেই একটা খোলা চত্বরে নিয়ে গেলো। একটা চায়ের দোকান, মোটামুটি বেড়াতে এসে বাঙ্গালীর যা যা প্রয়োজন সবকিছুই আছে। খুব পরিষ্কার না হলেও টয়লেটও পাওয়া গেলো। কফি খাওয়া হলো, কিছু চকোলেট আর চিপস্ কিনে আবার শুরু হলো মামার খোঁজ। বেশ কিছুটা নীচে নেমে গাড়িটা সমুদ্রের তীর ধরে এগোতে থাকলো। ডানহাতে আস্তে আস্তে জঙ্গল উপরের দিকে উঠে গেছে আর বাঁহাতে ভারত মহাসাগর। বিজয় জানালো এই বীচটা নাকি আগে ছিলো না। সুনামিতে তৈরী হয়েছে। একজায়গায় গাড়ী থামিয়ে ফ্রেশ লেপার্ডের পায়ের ছাপ দ্যাখালো বিজয়। ঋজু বললো “সবই তো হলো গুরু! কিন্তু মামা কই!” বিজয় কিছু না বুঝেই একটু হাসলো। গাড়ী আবার সমুদ্রের তীর ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকলো। বিজয় আজ লেপার্ড দেখিয়েই ছাড়বে। টোড়ি বললো “আহারে! ও বেচারা চিন্তায় পড়ে গেছে। যদি লেপার্ড না দ্যাখাতে পারে তাহলে তো ৫০% টাকা কাটা যাবে! ওকে প্লিজ বলো আমরা ওর টাকা কাটবো না। ও যেনো টেনশন বা করে।” অরিত্র বললো “এটা বললে যাও বা লেপার্ড দ্যাখার সম্ভাবনা ছিল তাও থাকবে না।”
আর কিছুটা এগোতে আবার একটা জলাশয়। একটা হাতির ফ্যামিলি মজাসে স্নান করছে। কি সুন্দর একটা শাসন। পুচকি হাতি দুটো এদিক ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করলেই ওদের দাদা দিদিরা অলমোস্ট কান ধরে আবার নিজেদের কাছে নিয়ে আসছে। কিন্তু বড়ো হাতি দুটোই নির্বিকার। তিস্তা বলে উঠলো “কি সুখী পরিবার দেখেছো”!
গাড়ী আবার বিজয়ের ইনস্ট্রাকশন মেনে নানান পথে ঘুরতে লাগলো, বোঝাই যাচ্ছে বিজয়ের এখন একটাই টার্গেট “মিশন লেপার্ড”!
এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে যখন প্রায় সোয়া এগারোটা বাজে বিজয় ঋজুকে বলেই ফেললো যে আজ বুঝি আর মামাকে দেখা যাবে না। যদি ঋজুরা চায় তাহলে আজ বিকেলে বা কাল সকালে ডিসকাউন্টেড রেটে আরেকটা সাফারি নিতে পারে। এরপর রোদের তেজ বাড়লে লেপার্ড দেখার সম্ভাবনা আরও কমে যাবে কারণ তখন নাকি লেপার্ডরা রোদ থেকে বাঁচতে পাথরের আড়ালে বা ছোটখাটো গুহায় ঢুকে পড়ে। এসব শুনে স্বভাবতই সকলে একটু হতাশ হয়ে পড়লো। অরিত্র ঋজুকে জিজ্ঞাসা করলো “কি করবি? কাল সকালে কি আরেকবার আসবি? বুঝতেই পারছি লেপার্ড দেখতে পাওয়া একটা লাকের ব্যাপার। শুনেছি কেউ কেউ একমাসেও দেখতে পায়না আবার কপাল ভালো থাকলে কেউ কেউ জঙ্গলে ঢুকেই ওনার দ্যাখা পেয়ে যান! যাইহোক কি করবি তাড়াতাড়ি ঠিক করা যাক!” এই বলতে বলতেই টোড়ি হঠাৎ তিস্তার বাঁ হাতটা খিমচে ধরলো আর ডান হাত দিয়ে পেছনে ডানদিকে ইশারা করে অস্ফুট গলায় বললো “বা য়া য়া ঘ্”! ঋজু ড্রাইভারের পিঠে হাত রেখে গাড়ী থামাতে বলে পেছন ফিরে দ্যাখে কাছেই একটা বড় পাথরের চাতালের ওপর একটা লেপার্ড মুখে করে একটা হরিণকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। গাড়ীটা একটু ব্যাকে আনতেই দৃশ্যটা স্পষ্ট হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে লেপার্ড স্যার শিকার মাটিতে রেখে নিজে তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতেই স্যারের বন্ধু বা বান্ধবী কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়ালেন। টোড়ির মুখে কথা নেই, তিস্তার হাতে ব্যথার কোনো অনুভূতি নেই। ঋজুরাও ছবি না তুলে হা করে তাকিয়ে আছে। এসব দেখে বিজয়ের মুখে এক তাচ্ছিল্য ভরা হাসি ফুটে উঠলো, বললো “টেক ফটো স্যার, টেক ফটো! লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স, ভেরি ভেরি রেয়ার সিন।” অরিত্রদের উপস্থিতি লেপার্ড যুগলকে মোটেই বিব্রত করলো না। বরং একে অন্যের সাথে একটু খুনসুটি করতে শুরু করলো। ঋজুরা বেশ কিছুক্ষণ ওই দৃশ্য উপভোগ করে যখন ফেরার জন্যে রওয়ানা দেবে ততক্ষণে বিজয় বাবুর কাছ থেকে খবর পেয়ে অন্তত আরও চারটে সাফারি জিপ এসে হাজির হলো এবং যথারীতি হৈ হল্লা শুরু। যেহেতু মহারাজ বিজয়রত্নে লেপার্ডোসিংহেরা এতো গোলযোগ সইতে পারেন না, তাই মৃত সাড়ঙ্গটিকে মুখে তুলে নিয়ে মহারাজ বিজয়রত্নে লেপার্ডোসিংহে তার সঙ্গীর সাথে চাতালের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন! যতক্ষনে ঋজুদের সম্বিত ফিরে এলো ততক্ষনে গাড়ী হোটেলে পৌঁছে গেছে।
হোটেলে ফিরে বিজয়রত্নে প্রাপ্য পুরো টাকাটাই শুধু পেলেন না তারওপরে টোড়ি মেমসাহেবের কাছ থেকে একটু উপরিও পেলেন। সবাই খুশি কিন্তু হাত খিমচে দেবার জন্যে টোড়ি তিস্তাকে অন্তত পনেরোবার সরি বললো। তিস্তা বললো “কিন্তু তুমি না খিমচালে এই দৃশ্য তো আর দেখতে পেতাম না! তাই তোমার অপরাধ ইজ পারডনড।”
হোটেলের লবিতেই দুলাঞ্জনা অপেক্ষা করছিলো। ঋজুরা লেপার্ড দেখতে পেয়েছে জেনে খুব খুশি হলো। দুলাঞ্জনা বললো “তোমরা তো ব্রেকফাস্ট করোনি, কিছু একটু খেয়ে নাও তারপর কথা বলবো।” তিস্তা লবিতেই স্যান্ডুইচ আর কফির অর্ডার দিলো, দুলাঞ্জনাকেও জয়েন করতে বললো। খেতে খেতে দুলাঞ্জনা বললো “তোমাদের যেহেতু আর সাফারির দরকার নেই তাহলে তোমরা আজ বিকেলে এল্লা চলো, কাল সকালে ওখান থেকে ট্রেনে ক্যান্ডি যাবে। এই ট্রেন জার্নিটা ওয়ান অফ দ্যা বেস্ট অফ ইটস কাইন্ড।” “কিন্তু আমরা তো ন্যুয়ারা এলিয়া থেকে কলম্বো যাবো!” অরিত্র বলে উঠলো। দুলাঞ্জনার বক্তব্য সব ক্যানসেল করে দিয়ে এখন থেকে এল্লা, এল্লাতে অভারনাইট তারপরে ভোরে এল্লা থেকে ট্রেনে ক্যান্ডি। ক্যান্ডিতে রাতটা কাটিয়ে বা হাতে সময় থাকলে আর একদিন থেকে সেখান থেকে গাড়িতে কলম্বো। বললে দুলাঞ্জনা সব ব্যবস্থা করে দেবে। ঋজু ঘন্টাখানেক সময় চাইলো, বললো জানাচ্ছে। ঋজু সব হোটেলের সাথে কথা বলে হিসেব করে দেখলো খুব একট লস নেই। বাকিরাও রাজি। দুলাঞ্জনা শুধু জানতে চাইলো, ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস না সেকেন্ড ক্লাস। ফার্স্ট ক্লাস এ সি কিন্তু সেকেন্ড ক্লাস থেকে খোলা জানালা দিয়ে দৃশ্য বেশি ভালো। ঋজুরা সেকেন্ড ক্লাসেই রাজি হয়ে গেলো। দুলাঞ্জনা বললো ঋজুদের এল্লাতে ট্রেনে তুলে ও ক্যান্ডি চলে যাবে। ঋজুরা ক্যান্ডি স্টেশনে পৌঁছেই দুলাঞ্জনাকে পেয়ে যাবে।
লাঞ্চ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে সাড়ে চারটে নাগাদ ওরা বেরিয়ে পড়লো এল্লার পথে। পথে এক জায়গায় হঠাৎ গাড়ী দাঁড়িয়ে পড়লো। দুলাঞ্জনা বললো এটা নাকি জংলী হাতিদের খাওয়ানোর সময়। এইসময় নাকি প্রচুর হাতি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে কলা খাওয়ার জন্যে। যারাই গাড়ী করে যায় ওদের কলা দ্যায়। আর এই সুযোগে লোকাল লোকেরা একটু আগের থেকে কলা বিক্রি করতে শুরু করে। বলতে বলতে দুটো বাচ্চা ছেলে দুকাঁদি কলা নিয়ে এসে হাজির। যদিও টোড়ি বাচ্চা বলে দাম কমাতে দিচ্ছিলো না দুলাঞ্জনা মোটামুটি একটা রফা করে দুকাঁদি কলা কিনলো। সত্যি হাতিগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর সবাই কলা দিয়ে যাচ্ছে। ওরাও তাই করলো।
দুলাঞ্জনা বললো এরা সব যেহেতু জংলী তাই কেউ এদের রাগাতে চায় না।
অনেকটা যাওয়ার পর রাবণ ফলস এলো। তার আগে সমুদ্রের তীরে জলের মধ্যে একদল লোক লাইন দিয়ে একটা করে বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে কি একটা করছিলো দেখে তিস্তা দুলাঞ্জনাকে জিজ্ঞেস করলো ওরা কি করছে। “ওরা জেলে, জোয়ারের সময় ওরা এইরকম ভাবে বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে মাছ ধরে। এটা এখানকার খুব প্রাচীন পদ্ধতি।
এল্লা পৌঁছাতে সাড়ে সাতটা বেজে গেলো। অন্ধকারে শহরটা খুব একটা বোঝা যাচ্ছিল না। তবে জায়গাটা যে খুব শান্ত নিরিবিলি পুরনো শহর সেটা বোঝা গেলো। শীত বলা যাবে না, তবে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ওয়েদার।
সকালবেলা ছটা চল্লিশে ট্রেন। দুলাঞ্জনা ঠিক সাড়ে পাঁচটায় এসে হাজির। অরিত্ররা ঠিক ছটায় স্টেশনে পৌঁছে গেলো। ছোট্ট স্টেশন। প্লাটফর্মটা খুব বেশি হলে শদেড়েক ফুট লম্বা হবে। অল্প কিছু লোক থাকলেও খুব শান্ত পরিবেশ। প্ল্যাটফর্মের একদিকে সবুজ পর্দা ঝোলানো স্টেশন মাস্টারের ঘর। বোঝাই গেলো উনিই একা স্টাফ। স্টেশনটা দেখে ঋজুর মালগুড়ী ডেজের মালগুড়ী স্টেশনের কথা মনে পড়ছিলো।
পাঁচ কামরার মিটার গেজ ট্রেন এসে প্লাটফর্মে দাঁড়াতে সবাই কোনো হুটোপুটি না করে ধীরে ধীরে গিয়ে নিজের নিজের জায়গায় বসলো। ঋজুরা ট্রেনে উঠলে দুলাঞ্জনা চলে গেলো, ওকে আবার তো ক্যান্ডি যেতে হবে।
ট্রেন ছাড়লো, কয়লার ইঞ্জিনের সাইরেন দিয়ে! স্টেশন ছেড়ে একটু যেতেই দুপাশে প্রকৃতির বায়োস্কোপ শুরু হলো। মেঘে ঢাকা পাহাড়ের কোল ধরে ট্রেন চললো কুঁ ঝিক ঝিক করে। দুপাশে গাঢ় সবুজ রঙের চা বাগান। মাঝে মধ্যে দুএকটা বড় গাছ। চা বাগান শেষ হতেই হঠাৎ সামনে এসে হাজির ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রাম। তার পাশ দিয়ে দুটো ঝরনা নেমে নদী হয়ে বয়ে চলেছে। ভারী সুন্দর। আস্তে আস্তে ট্রেন নামলো নীচে, চলতে শুরু করলো এক নাম না জানা পাহাড়ি নদীর গা দিয়ে। দুপাশে উঁচু পাহাড়, তাতে বিবিধ রকমের সবুজের মেলা। মাঝে মাঝেই ছোটো ছোটো ঝরনা। পাহাড়ের গা টা আরো কিরকম মায়াময় হয়ে উঠছে মেঘের ছায়ায়। একটু পরেই একটা স্টেশন এলো। নাম জানা গেল না, কারন স্থানীয় ভাষায় লেখা। তবে সহযাত্রীদের কাছে শুনে বোঝা গেলো নাম বাদুল্লা আম্বালামা। খুব ছোট্ট স্টেশন, এল্লার থেকেও ছোটো। একজন হকার উঠলো কাটা রসালো আনারস নিয়ে। দারুন খেতে। যেমন রস তেমনি স্বাদ। স্বপ্নের ট্রেন পাহাড়ের কোল ধরে উঁচু নিচু পথে ধীর গতিতে এগিয়ে চললো।
রাবণ রাজার দেশের পাহাড় ডিঙিয়ে, মেঘের রাজা মেঘনাদের দেশ পার হয়ে ট্রেন এসে পৌঁছালো ক্যান্ডিতে। মনে হলো যেন একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভাঙলো। দারুন অভিজ্ঞতা। স্টেশন থেকে বেরিয়েই দুলাঞ্জনার সাথে দেখা। তিস্তারা সবাই মিলে দুলাঞ্জনাকে অনেক ধন্যবাদ জানালো এইরকম একটা সুন্দর ট্রেন রাইড সাজেস্ট করার জন্যে।
স্টেশন থেকে সোজা হোটেল। বেশ ঠাণ্ডা এখানে। একটা পাতলা গরম কিছু হলে বেশ ভালো হয়। ক্যান্ডি শহরটা টিপিক্যাল হিল স্টেশন, ইংরেজ আমলে তৈরী করা। পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ওরা শেষে হোটেলে এসে পৌঁছালো। বেশ উঁচুতে হোটেলটা। লবিটা যে ফ্লোরে ঘর তার নীচের ফ্লোরে। সুন্দর হোটেল। তিনদিকে পাহাড় একদিকে বিশাল একটা ভ্যালি। দুপুরে লাঞ্চ করতে গিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে পুরো ভ্যালিটা দেখতে পেলো ওরা। বিস্তীর্ণ ভ্যালি, তার ঠিক মাঝখানে দিয়ে একটা নদী বয়ে চলেছে, দুপাশে পাহাড়। হোটেলের জানালার হাইটেই মেঘ উড়ে যাচ্ছে। স্বপ্নের মতো জায়গাটা।
সন্ধ্যেবেলায় সবাই ঋজুদের ঘরে বসে আড্ডা মারছিল। কিরকম একটা মনখারাপের আবহাওয়া। যদিও তিস্তাকে সবাই অনেক ধন্যবাদ জানালো শ্রীলঙ্কা সাজেস্ট করার জন্যে, কিন্তু সবারই মন একটু খারাপ। বেড়ানো তো প্রায় শেষ, এরপরেই বাড়ী ফিরে আবার দিনগত পাপক্ষয়।
তবে ওরা চারজনেই একসাথে প্ৰমিস করলো সামনের বছর আবার একসাথে কোথাও বেড়াতে যাবে।
Bah! Bah! Bah!
Simply a-s-a-d- h-a-r-o-n
Sudhumatro poribeshonar gunei bajimat …
Duradanto bhromon holo