চিত্রাঙ্গদার দেশে

লেখা- তীর্থ দাশগুপ্ত , ছবি – ঋতু দাশগুপ্ত , অলঙ্করণে- কৌশিক চক্রবর্তী

উত্তর পূর্ব ভারতের ৭ টি অঙ্গরাজ্য বা সাত বোনের মধ্যে চার বোনের সাথে সাক্ষাৎ ইতিপূর্বেই আমাদের সাথে হয়েছে । আর তা বেশ ভালোভাবেই হয়েছে । অতএব এবারে বড়দিনের ছুটিতে পরিকল্পনা হলো উত্তর পূর্ব ভারতের রত্ন – মণিপুর দর্শন ।

ভ্রমণ পরিকল্পনায় মণিপুরের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বাড়িতে বয়োঃজ্যেষ্ঠদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ কিছুটা থাকলেও ইতিপূর্বে ইন্টারনেটে দেখা ছবি ও ওখানকার অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর কৃষ্টি সংস্কৃতির অমোঘ আকর্ষণ শেষ পর্যন্ত টেনে আনলো আমাদের এদেশে । আমার ভ্রমণ সঙ্গিনী তথা অর্ধাঙ্গিনী শুধু একবার প্রশ্ন করে ” দেখো , কোনো সমস্যা নেই তো ওখানে ? ” । তার উত্তরে আমি আস্বস্ত করি ” কুছ পরোয়া নেহি ” । আমি তার আগেই ইম্ফল নিবাসী আমার বন্ধুর থেকে ওখানকার আইন শৃঙ্খলা পরিবেশ জেনে নি । জানতে পারি মণিপুর আর সেই আগের মণিপুর নেই যখন বিকেল ৩টে ৪টে বাজতে না বাজতেই সকলে দোকান বাজার বন্ধ করে ঘরে ঢুকে যেত । এবারের মণিপুর সফরে এসে নিজেও সেটা প্রত্যক্ষ করি , অনেক রাত পর্যন্ত ইম্ফল এর ইমা মার্কেট চত্বরে লোকের ভিড়, রাত পর্যন্ত রাস্তায় অনেক গাড়ি চলাচলের আওয়াজ । সত্যি কথা বলতে কি নাগাল্যান্ড , মণিপুর বলতে যে ছবি চোখের সামনে ভাসে , মানে রাস্তায় নিরাপত্তাবাহিনীর টহলদারি আর সূর্য ডুবলেই চারিদিক শুনশান সেই ধারণা পুরোপুরি পাল্টে গেলো । এখানে ভ্রমণে আসার আগে পর্যন্ত মনিপুর কে আমি চিনতাম চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারীর দেশ হিসেবে কবিগুরুর কল্যানে । পাণ্ডব রাজপুত্র অর্জুন চিত্রাঙ্গদার সাথে কীভাবে সাক্ষাত করেছিলেন তা মহাভারতে বর্ণিত হয়নি। সেই বিবরণটি বর্ণিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক চিত্রায় , যেখানে রবি ঠাকুর চিত্রাঙ্গদাকে পুরুষ পোশাক পরিহিত যোদ্ধা হিসাবে চিত্রিত করেছেন। তার সততা ও সাহসের কারণে অর্জুন তার প্রেমে পড়েছিলেন। নির্বাসনের সময়কালে অর্জুনের বিচরণ তাঁকে প্রাচীন মণিপুরার রাজ্যেও নিয়ে যায়।

যাই হোক শেষমেষ যাওয়ার দিন এলো আর আমি স্ত্রী , কন্যা সহ ইন্ডিগোর ১ ঘন্টার ছোট্ট উড়ানে এসে পড়লাম ইম্ফলের আকাশে । বিমান অবতরণের সময়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। কন্যার কৌতূহলী প্রশ্ন ” বাবা , নিচে জল দেখতে পাচ্ছি আর উপরে ভেসে থাকা ওগুলো কি ? “, দেখে মনে হল ওগুলোই বোধয় ভাসমান জমি যার সম্বন্ধে ভূগোলে পড়েছি । লোকতাক লেক , নাচুনে হরিণ , ভাসমান জমি । শুরুতেই বেশ রোমাঞ্চ হল । এই সফরে লোকতাক লেক এর পাশে আবার এক রাত থাকার ও কথা । সেটা একটা বাড়তি আকর্ষণ । প্লেনটা একটু ইমফল এর আকাশে চক্কর কেটে রানওয়ে তে নেমে পড়ল । প্লেন থেকে নেমে লাগেজ কালেক্ট করে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে একজন মাঝারি উচ্চতার চোখে চশমা মাঝ বয়েসী লোক দাঁড়িয়ে আছেন , পাশে শ্যামবর্ণ একটু মোটাসোটা টুপি পরা একটি অল্প বয়েসী লোক । আমরা এগিয়ে গেলাম তার দিকে ।মাঝবয়েসী ভদ্রলোক ও পাশের টুপি পরা অল্প বয়েসী লোকটি আমাদের হাত থেকে সব কটি লাগেজ নিয়ে এগোতে লাগলেন । একটু হেঁটে এসে পড়লাম গাড়ী পার্কিং লট এ । উঠে পড়লাম একটা সাদা স্করপিও তে । তারপর সাঁসাঁ করে ইমফল এর রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটল শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে । যেতে যেতে আলাপ হলো। চশমা পড়া ভদ্রলোকটি হলেন আমাদের গাইড রাজু , পুরো মণিপুর সফরেই উনি আমাদের সাথে থাকবেন । আর টুপি পড়া লোকটি হলেন আমাদের চালক ইরফান । সদা আলাপি হাসিখুশি রাজু বাবু আমাদের সারা রাস্তা মনিপুর সম্বন্ধে একটা ছোটোখাটো বক্তৃতা দিতে দিতে এলেন । বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত নির্যাস হল -মণিপুর উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য, ইম্ফল শহরটির রাজধানী । এর উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম এবং পশ্চিমে আসাম । এর সীমান্তে রয়েছে মায়ানমারের দুটি অঞ্চল এবং চীন দেশের কিছু অংশ । রাজ্যটি ২২৩২৭ বর্গকিলোমিটার (৮৬২১ বর্গ মাইল) আয়তন বিশিষ্ট এবং প্রায় ৩০ লাখ জনসংখ্যা দ্বারা অধ্যুষিত । মেটেই সহ, যারা এই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী তারা হল পাঙ্গাল বা পাঙ্গান (মণিপুরী মুসলিম), নাগা উপজাতি, কুকি / জো উপজাতি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়গুলি, যারা বিভিন্ন চীনা-তিব্বতি ভাষায় কথা বলে।
রাজুর ভাষণ শুনতে শুনতে কখন যেন চলে এলাম সাগলবন্দ রোড এ শহরের কেন্দ্রস্থলে হোটেল পোলো তে ।

রাজুর পরামর্শেই এরপর ঝটপট চেকইন করেই নেমে এলাম হোটেল এর নিচতলায় “লাক্সমি কিচেন ” এ মণিপুরী রান্নার স্বাদ নেওয়ার জন্যে ।

মণিপুরী রান্নাঘর সাধারণত মৈতেই দের ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিদিনের আহারাদি ভাতের উপর ভিত্তি করে হয়, এছাড়া থাকে শাকসবজি এবং মাছের কয়েকটি পরিবেশন । খাদ্য পদ তালিকায় থাকে সাধারণত এনসাঙ বা অ্যাথংবা নামে একটি উদ্ভিজ্জ স্টু যা শুকনো বা ভাজা মাছের গন্ধযুক্ত ;এছাড়া থাকে কাঙহৌ নামক ভাজা সবজি; এবং একটি মশলাদার আইটেম, কোনোটা বা মরোক মেটাপা (একটি মরিচের পেস্ট), অথবা ইরোম্বা (কাঁচা মরিচ এবং ফার্মেন্টেড মাছের সাথে সিদ্ধ ও কাঁচা শাক) অথবা সিঞ্জু (একটি তীব্র স্বাদ যুক্ত স্যালাড) । আমরা ওই তিনটে পদেরই রসাস্বাদন করেছিলাম । সমস্ত সাইড ডিশের সাথে একধরণের তাজা ভেষজ মিশ্রিত থাকে যাকে মারোই বলে। মৈতেই রান্নার মূল বৈশিষ্টই হ’ল এনগারি নামের ফার্মেন্টেড মাছ। বাঙালী দের মতই এরা মৎসভুক কিন্তু দেখলাম ফার্মেন্টেড মাছ একমাত্র এই প্রদেশেই খাদ্য তালিকায় বিশেষ স্থান নিয়েছে ।

সামান্য চিনি যুক্ত সিদ্ধ সবজি এপেটাইজার হিসেবে খুব জনপ্রিয় এখানে। আমরা পাতে পেয়েছিলাম পেঁপে সেদ্ধ । বেশিরভাগ মৈতেই আহারের গন্ধেন্দ্রিয় উত্তেজিত করার ক্ষমতা শুরু হয় সরিষার তেলে তেজপাতা, রসুন এবং আদা ভাজার সাথে ।সাথে যোগ্য সঙ্গত করে সেই ” মারোই ” । লাক্সমি কিচেনের মধ্যে ঢুকেই সেই গন্ধের সাক্ষী আমরাও হলাম । দেখলাম সার সার টেবিল আর বেঞ্চ পাতা আছে রেস্টুরেন্ট এ । স্থানীয় মানুষজন নারী পুরুষ সকলেই দ্বিপ্রহরের আহারাদি তে ব্যস্ত । টুরিস্ট প্রায় নেই বললেই চলে । এক কোণের দিকে একটু ফাঁকা টেবিলে বসলাম আমরা তিনজনে । তারপর স্থানীয় দুইজন মৈতেই ছেলে যৌথভাবে কিছু সময় অন্তর অসংখ্য ছোট ছোট বাটিতে অতিসুস্বাদু পদের ব্যঞ্জন সমষ্টির পরিবেশনের যা নমুনা পেশ করলেন তা আমাদের আড়াই জনের খিদেতে চুই চুই করা পেট তৃপ্তি সহকারে ভরিয়ে দিল । এরা দেখলাম বেশিরভাগ মূল স্টুতে তেল খুব অল্প পরিমাণে ব্যবহার করে তবে তেল চপচপে ” কাঁঝৌ “( ভাজা মশলাদার শাকসব্জী) এবং “বোরা “বা ফ্রিটার এ সেটা পুষিয়ে যায় ।
শরীর ও মনের তৃপ্তি নিয়ে লাক্সমি কিচেন থেকে বেরিয়েই এরপর রাজু বাবুর তত্ত্বাবধানে সেই স্করপিও তে চললাম আমরা কাংলা ফোর্ট দেখতে ।

কাংলা ফোর্ট মণিপুর রাজ্যের ইম্ফলের একটি পুরানো প্রাসাদ। এটি ইম্ফল নদীর তীরে উভয় পাশে (পশ্চিম এবং পূর্ব) অবস্থিত ছিল। তবে এখন এটি কেবল পশ্চিম দিকেই রয়েছে। এখন কেবল ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। কাংলা মানে পুরানো মৈতেই ভাষায় “শুকনো জমি”। এটি মণিপুরের অতীতে মৈতেই শাসকদের ঐতিহ্যবাহী স্থান ছিল । বিখ্যাত কাঙলা গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই মনটা বহু বহু প্রাচীন কালে হারিয়ে গেলো , সেই ২০০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে যখন দেবতারা রাজত্ব করতেন এই ভূমি । পাংখোয়া হলেন এখানকার সর্বশক্তিমান .ঈশ্বর। কথিত আছে তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি নিজের দেহকে অন্য কোনও রূপে প্রাণীর মতো এবং অন্যকেও একজন শক্তিশালী ঈশ্বৰ হিসাবে পরিবর্তন করতে পারতেন। প্রাচীনকালে এই পখাংবা খ্রিস্টপূর্ব ২০,০০০ সালে “ওয়াকোকলন হিলিলে থাইলেল সালাই আমাই ইয়েলন পুকোক পুয়া” নামক প্রাক হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে এই কাংলা প্রাসাদেই প্রথম সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন, মনে হলো যেন সেই প্রাচীন মৈতেই দেব দেবীর জগতে পৌঁছে গেছি । সুন্দর মৈতেই স্থাপত্যের খিলান ওয়ালা কাংলা গেট পেরিয়ে আস্তে আস্তে মূল রাজপথ ধরে হেঁটে চলে এলাম রাস্তার বাম পাশে পাংখোয়া দেবের মন্দিরে । সেই শত সহস্র খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইহজগতের মানুষ জনের জীবনযাত্রা ইতিহাসে জানা যায়না , কোন ইতিহাস ই বোধহয় সাধারণ মানুষের কথা বলেনা । ইতিহাস সতত রাজারাজড়ার কথাই বলে । পাংখোয়া মন্দিরে এসে দেখলাম কাঁচে ঘেরা শ্বেতশুভ্র এই মন্দিরে সর্পমুখ আর মাথায় শিং যুক্ত পাখওয়াম্বা দেবের এক পৌরাণিক রূপ । সাধারণ মণিপুর বাসীরা ধূপ দিয়ে তাদের প্রণাম নিবেদন করছেন ।

পাঙ্খয়া দেবের মন্দির, কাংলা দুর্গ

মন্দির থেকে বেরিয়েই ব্যাটারী চালিত গাড়ীতে এলাম বিখ্যাত কাংলা মিউজিয়ামে । মণিপুরের পুরানো ভিক্টোরিয়ান বিল্ডিংয়ের কাংলা যাদুঘরটি কাংলার সংস্কৃতি, পৌরাণিক কাহিনী ও কিংবদন্তি তুলে ধরেছে । যাদুঘরে দুটি গ্যালারী রয়েছে। প্রথমটিতে রয়েছে মণিপুরের শাসকদের প্রতিকৃতি, কাংলা দুর্গের মডেল, বিভিন্ন সময়কালের রাজ্যের মানচিত্র ইত্যাদি। দ্বিতীয় গ্যালারীটি কাংলা থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দ্বারা সজ্জিত । আমাদের সেই ব্যাটারী চালিত গাড়ীর চালক ও গাইড “ইয়াই হেনবা ” আমাদের ধারাবিবরণী দিতে থাকেন । ইয়াই বলেন জানেন কি ” মণিপুরের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্রের পীঠস্থান হওয়ায় কংলা বহু শতাব্দী জুড়ে এক দুর্গ নগরীতে পরিণত হয়েছে। এই রাজধানী থেকেই মঙ্গং বংশ ধীরে ধীরে পর্যাপ্ত রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছিল এবং বেড়ে উঠেছিল মণিপুরের সর্বাধিক প্রভাবশালী বংশ হিসাবে। কাংলা দুর্গের শ্রীবৃদ্ধির প্রধান লক্ষণগুলি ১৫৯৭-১৬১২ খ্রিস্টাব্দে চীনা বিজয়ী রাজা খাগেম্বা র আমলে পরিলক্ষিত হয় । রাজকাহিনীর ইতিহাস অনুসারে, খাগেম্বা কাংলা দুর্গের পশ্চিম গেটে একটি ইটের প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। মনে হয় ইট তৈরির শিল্পটি মনিপুরের পূর্ব সীমান্তে চীনা আগ্রাসনের সময় বন্দী হওয়া চীনা বন্দীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। খাগেম্বার পুত্র খুঞ্জোবা ,যার রাজত্বকাল ১৬৩২ থেকে ১৬৬৬ খিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপৃত , কাংলা দুর্গের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে উন্নতি করেছিলেন। কথিত আছে যে, রাজা দুর্গের পশ্চিম পাশে একটি পরিখা বা থানগাপট খনন করেছিলেন। তাঁর আমলে মণিপুর শক্তি ও প্রতিপত্তিতে ছিলো একেবারে শীর্ষে । তৎকালীন বার্মিজ রাজা তাঁর বিরোধ নিষ্পত্তি করতে এবং মণিপুরী রাজকন্যাদের পাণিপ্রার্থী হয়ে তাঁর কাছে এসেছিলেন। দুর্গটি আরও উন্নত ও প্রসারিত হয়েছিল রাজা গারীবানীওয়াজ এবং তার পরে মণিপুরের একের পর এক অনান্য রাজাদের আমলে ।এরপর ১৭৬২ থেকে ১৭৯৮ খীষ্টাব্দে মহারাজা ভাগ্যচন্দ্রের রাজত্বকালে বার্মার দ্বারা বার বার আক্রমণের কারণে কাংলা বেশ কয়েকবার ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় । ” একটানা এই ধারাবিবরণী র পর ইয়াই একটু থামেন ।

ঘুরে ঘুরে মনিপুর সম্রাটদের ছবি ইত্যাদি দেখতে থাকি আমরা । ভাবতে অবাক লাগে কি করে একশো বছর আগের বৈবাহিক সম্বন্ধ প্রার্থী বার্মিজ রাজপরিবারের সাথে বৈরিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয় মহারাজা ভাগ্যচন্দ্রের আমলে । মনিপুরী বীর যোদ্ধা সৈন্যবাহিনীর সহায়তায় মহারাজ গম্ভীর সিং মণিপুরকে সাত বছর ধরে যুদ্ধে দখলকারী বার্মিজ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। জাদুঘর দেখে এরপর আবার সেই ব্যাটারী গাড়িতে এলাম এক জায়গায় যেখানে বৃটিশরা প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে যুবরাজ বীর টিকেন্দ্রজিতের বিরুদ্ধে । মনিপুরীরা বীরের জাত , বীরের পূজারী এরা । লক্ষ্য করলাম ইয়াই বেশ আত্মগরিমার সাথে অ্যাংলো মনিপুর যুদ্ধের বিষয়ে বর্ণনা করলেন। ইয়াই বললেন ” রাজা চন্দ্রকৃতি তাঁর বড় পুত্র সুরচন্দ্রের স্থলাভিষিক্ত হন। তবে সে তার সৎ ভাইদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলস্বরূপ, সেনাপতি টীকেন্দ্রজিৎ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং তাঁর নিজের ভাই যুবরাজ কুলচন্দ্রকে মণিপুরের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন । এই সময় থেকেই , ব্রিটিশরা মণিপুরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে থাকে । তারা আসামের চিফ কমিশনার কুইন্টন কে কাংলা দুর্গে পাঠান সেনাপতি টীকেন্দ্রজিৎ কে নির্বাসন দেওয়ার জন্য। ওনার নির্দেশে ব্রিটিশ বাহিনীর ১৮৯১ সালের অ্যাংলো-মণিপুর যুদ্ধ শুরু হয় যার অন্তিম পরিণতি হয় অত্যন্ত করুন ভাবে বীর টীকেন্দ্রজিৎ এর প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে” ।

প্রাচীন কাংলা দুর্গের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের ছবি

এরপরে সামান্য হেঁটে এলাম সেই প্রাচীন দুর্গের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের কাছে । সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে রাজা খাগেম্বার রাজত্বকালে কুড়ি ফুট উঁচু এই কেল্লা পোড়া ইট দিয়ে তৈরি হয়েছিল । পাখংবার রাজ্যাভিষেকের জায়গা সহ বেশ কয়েকটি পবিত্র স্থান ছিল দুর্গের ঘেরাটোপের ভিতরে অবস্থিত। দুর্গের তিনটি প্রবেশপথ ছিল, দুটি পশ্চিম দিকে এবং একটি দক্ষিণ দিকে। পশ্চিম মুখের বাম প্রান্তে প্রবেশ পথটি করোনেশন হলের বিপরীতে এবং একই প্রাচীরের ডান প্রান্তের প্রবেশদ্বারটি দরবার হলের মুখোমুখি অবস্থিত ছিল সেই আমলে । দক্ষিণ প্রবেশদ্বারটি শ্রী – শ্রী গোবিন্দজী মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথের সাথে সংযুক্ত ছিল।

কল্পনা করলাম প্রায় ৩০০ বছরে আগে এ পথেই মণিপুর অধীশ্বর , রাজমাতা ও রাজপরিবারের অন্যান্ন বিশিষ্ট জন এ পথেই গোবিন্দজীর উদেশ্যে পূজা নিবেদন করতে যেতেন এরকম কোনো শেষ দুপুরে কিংবা প্রাতঃকালে । চারিদিকে তখন হয়তো শিঙ্গা বাজতো বা নহবত খানায় পেনা বাজতো যা কিনা একতারা জাতীয় প্রাচীন মৈতেই বাদ্যযন্ত্র । ” চলুন এবারে আমরা প্রাচীন গোবিন্দজি মন্দির দর্শন করে আসি ” , ইংরিজি তে বলা ইয়াই এর কথায় ঘোর কেটে গেল । কেল্লার ধংসাবশেষ পেরিয়ে এলাম ধূসর হলুদ বর্ণের এই প্রাচীন গোবিন্দজি মন্দির এ । আশেপাশে দেখলাম অনেক ইম্ফল নিবাসী বা স্থানীয় মণিপুরবাসী এসেছেন ঘুরতে । তবে পর্যটকের সংখ্যা হাতে গোনা । বড়দিনের ছুটি হওয়া সত্ত্বেও বাইরের পর্যটক নেই বললেই চলে । আগেও লক্ষ্য করেছি উত্তর পূর্ব ভারতের এই অংশে বিশেষ করে নাগাল্যান্ড, মণিপুর বা মিজোরামে পর্যটকের সমাগম নেহাতই কম, নর্থ ইস্ট বলতে বাঙালী বা অন্যান্য পর্যটকরা বোঝেন শিলং, কাজিরাঙা বা খুব এডভেঞ্চার প্রিয় হলে বড়জোর অরুণাচল প্রদেশ , বমডিলা বা তাওয়াং । এবারেও এই ভরা মরশুমে এসে সেই ধারণা আরো মজবুত হল । ব্যতিক্রম কি আর নেই , নিশ্চই আছে ।

মণিপুর রাজ্যের মহারাজা নারা সিংহ পয়লা জানুয়ারী ১৮৪৬ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটি তাদের রাজ দেবতা শ্রী গোবিন্দজীকে উৎসর্গ করেন । ১৮৬৮ সালের একটি ভূমিকম্পের সময় মন্দির ও বিগ্রহের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। ফলস্বরূপ, মহারাজা চন্দ্রকৃতির (১৮৫৯-১৮৮৬) রাজত্বকালে মন্দিরটি তার মূল নকশায় পুনর্নির্মিত হয় এবং ২৬ এপ্রিল ১৮৭৬ -এ প্রতিষ্ঠিত হয় । কাঙলার শ্রীগোবিন্দজীর বর্তমান মন্দিরটি কাঠের তৈরি তিন আকারের ইট এবং সিমেন্ট মর্টার দ্বারা নির্মিত দ্বৈত কোষ কাঠামো। মন্দিরটি পূর্বমুখী এবং আয়তক্ষেত্রাকার যার প্লিন্থ টি ১.৩৪ মিটার উঁচু। মন্দিরে একটি আয়তক্ষেত্রাকার গর্ভগৃহ এবং একটি আয়তক্ষেত্রাকার বারান্দা বা অর্ধমণ্ডপ রয়েছে যা ধারণ করে রয়েছে কতগুলি গোলাকার স্তম্ভ । অর্ধমণ্ডপে পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণে তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। মন্দিরের বাইরের প্রাচীরে বেশ কিছু ফল্স উইন্ডো দেখতে পেলাম । সেই নকল জানালার গায়ের ফুলের নকশাগুলির সাজসজ্জার অবস্থা এখন জীর্ণকায় । বাহ্য এবং গর্ভগৃহের প্রাচীরের মধ্যে একটি চক্রাকার পথ বা প্রদক্ষিণ পথ দেখতে পেলাম । মন্দিরের ছাদটি গম্বুজের মতো কাঠামো আকৃতির । অর্ধমণ্ডপের সমতল ছাদ এবং বৃত্তাকার স্তম্ভগুলি মধ্যযুগীয় বাঙালি মন্দিরগুলির শৈলীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে, অপরদিকে গম্বুজ, রেলিংয়ের সজ্জা, বহিঃপ্রাচীরের পুষ্পশোভিত নকশাগুলি এবং ছোট ছোট মন্দিরগুলির নকশায় ইসলামী স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন লক্ষ্য করলাম । আমাদের গাইড ইয়াই জানালো “, মন্দিরটি পূর্ব এবং ইসলামী স্থাপত্য শৈলীর মিশ্রণের প্রতিনিধিত্ব করে বলে মনে করা হয়” । ইয়ায়ি এরপর ব্যাটারী গাড়ী তে বসিয়ে আমাদের নিয়ে এলেন আকাশের দিকে মুখ করা দুই বিশাল বপুর সিংহ মুখধারী ড্রাগন দেবতা র সামনে । প্রহরীর মতন দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা “উত্তরা ” বা মনিপুর রাজদের রাজ্জ্যাভিষেক স্থল এর প্রবেশ পথের সামনে । ইনি কাংলা শা নামে পরিচিত ।বেশ কিছু মুহূর্ত এই কাংলা শা র সামনে ক্যামেরাবন্দি করলাম আমরা । প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্বাস অনুযায়ী এই কাংলা শা অশুভ শক্তির হাত থেকে মনিপুর রাজ ও তার দেশ কে রক্ষা করে আসছেন সেই পুরাকাল থেকে ।

” কাংলা শা” র ছবি

ইয়াই এরপর গাড়িতে ঘোরাতে ঘোরাতে দেখালো নুংজেন ইকোন বা পবিত্র পুষ্করিণী । লোককথা অনুযায়ী পাখওম্বা দেবের বাসস্থান এই দীঘি । এরপর গাড়িতেই এক চক্কর মারতে মারতে দেখলাম নুঙ্গিবি বা যুদ্ধের দেবীর উপাসনাস্থল , ওয়াংবারেন দেব, কৌব্রু দেব বা বরুন দেবের উপাসনাস্থল , মহারাজ বোধচন্দ্রের সমাধি ইত্যাদি ।একটানা ধারাবিবরণী দিয়ে ইয়ায়ি আবার নামিয়ে দিলো আমাদের কাংলা গেট এর সামনে ।

কাংলা দুর্গ ও প্রাচীন গোবিন্দজি টেম্পল ভ্রমনের ভিডিও

মোহগ্রস্তের মতন প্রাচিন মনিপুরের ইতিহাস , পুরাতত্ত্ব , স্থাপত্য ইত্যাদির বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে আবার এসে উঠলাম রাজুর গাড়িতে ।

এরপর ঠিক ১ মিনিটের ড্রাইভে এসে পড়লাম শহীদ মিনারে । রাজু বললেন ” ১৮৪১ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় নিজের জীবন উৎসর্গকারী দেশপ্রেমিক মৈতেই গণ এবং অন্যান্য উপজাতি শহীদদের অদম্য চেতনাকে ইম্ফাল শহরের প্রাণকেন্দ্র বীর টিকেন্দ্রজিৎ পার্কে এই লম্বা মিনার দ্বারা স্মরণ করেন।” ।

বীর টিকেন্দ্রজিত পার্ক , ইম্ফল

বিকেল হয়ে এসেছিল তখন, প্রচুর স্থানীয় মানুষের সমাগম । ইতিউতি ছড়ানো বসার জায়গা গুলো এ বয়স্ক মানুষজনের আড্ডা চলছে । কোথাও বা অল্পবয়েসীদের ভীড় । আমাদের ও ইচ্ছা হচ্ছিল সেই আড্ডায় একটু অংশগ্রহণ করার কিন্তু বুঝলাম ভাষা অন্তরায় । হিন্দি এরা বোঝেন বা বলেন বটে কিন্তু সবাই তো আর হিন্দি তে অত সাবলীল নন ।আমাদের কলকাতাতেও সাধারণ মানুষজন কজন ই বা হিন্দী তে সাবলীল । যেকোনো নতুন দেশ কে চিনতে বা বুঝতে হলে স্থানীয় মানুষজনের সাথে মেলামেশার খুবই প্রয়োজন এটা আমরা মানি । এক্ষেত্রে রাজু সেই কাজটা আগাগোড়া করে যেতে লাগলেন একনাগাড়ে বলে চলা ঘরোয়া মেজাজের ধারাবিবরণীর মাধ্যমে যার ভিতরে অন্যান্য পেশাদার গাইডদের মতন কোনো আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়া ছিলনা । মৈতেই ভাষা প্রসঙ্গে রাজু বললেন ” মৈতেই অক্ষর আপনাদের বাংলা অক্ষরের মতন ” , আমি বলি ” সেটা আমি এয়ারপোর্টে নামার পর থেকেই লক্ষ্য করেছি ।” ” কিন্তু আগে কিন্তু এই বাংলা অক্ষরে ছিলনা ” রাজু বললেন একটা মৈতেই এ নিজস্ব স্ক্রিপ্ট রয়েছে, যা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছিল। এর প্রথম দিকের ব্যবহার জানা যায়নি। মণিপুর সাম্রাজ্যের শাসক পামেহিবা, যিনি হিন্দু ধর্মের প্রচলন করেছিলেন, মৈতেই লিপির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং বাংলা লিপি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্কুল এবং কলেজগুলিতে এখন বাংলা স্ক্রিপ্টটি ধীরে ধীরে মৈতেই স্ক্রিপ্ট দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। স্থানীয় সংস্থাগুলি তাদের নিজস্ব লিপি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে।
বাঙালি হিন্দু ধর্মপ্রচারক শান্তিদাস গোসাইয়ের প্ররোচনায় হিন্দু ধর্মান্তরিত রাজা পামেহিবার রাজত্বকালে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে অনেক মইতেই দলিল নষ্ট হয়ে যায়।” একটানা বলে থামেন রাজু । ” তারমানে হয়তো কত প্রাচীন ঐতিহাসিক নথি তখন নষ্ট হয়ে যায় , কত ইতিহাস চিরকালের মতন বিলীন হয়ে যায় , যুগে যুগে যে শাসক ই এসেছেন তিনিই তার পূর্বসূরীর সবটা ধ্বংস করে গুঁড়িয়ে দিযে নতুন করে তার নিজস্ব কীর্তিসৌধ , সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদি গড়েছেন তাঁর আপন বিশ্বাস অনুযায়ী । সব দেশেই সব কালেই এই ধারা দেখে আসছি ।সত্যি কি পূর্বসূরীর সবই খারাপ ? কত প্রাচীন ইমারত , শিল্প , সংস্কৃতি , পুঁথি এই করে পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে । মানবজাতির এ এক অপরিসীম ক্ষতি । ” , আমার কথায় সম্পূর্ণ সায় দেয় রাজু ।
বীর টিকেন্দ্রজিৎ পার্ক-এ বেশ কিছু ছবি তুলে এরপর হেঁটে এলাম পাশেই মনিপুর স্টেট মিউজিয়ামে । পৃথিবীর যে দেশে যে শহরেই যাই না কেন ছোট, বড়, মাঝারি জাদুঘর দেখতে পাই। আর আমার মতে মিউজিয়াম এক লপ্তে সেই দেশ বা শহরের ইতিহাস , ভূগোল, শিল্প , সংস্কৃতি, মনুষ্যজীবন , রাজনীতি , সমাজনীতি ইত্যাদি বোঝার এবং জানার সেরা জায়গা । এই মনিপুর স্টেট মিউজিয়ামও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রায় ঘন্টাদেড়েক কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এলাম পাশেই পোলো গ্রাউন্ডে । রাজু বললেন “ জানেন কি ভারতে পোলো খেলা প্রচলিত হওয়ার বহু বহু আগে থেকে পোলো খেলা চলে আসছে মনিপুর এ । কাংলা ফোর্টের ভেতরে যে পোলো মাঠ আছে সেটা রাজাদের জন্য আর বাইরে এই যে মাঠ টা দেখছেন এটা প্রজাদের জন্য নির্দিষ্ট । । আজ ও এখানে পোলো খেলা চলে”।

বিকেল গড়িয়ে ধীরে ধীরে তখন সন্ধে হতে চললো । আমরা এরপরে স্করপিও চেপে চললাম আজকের শেষ গন্ত্যব্য বিখ্যাত ইমা মার্কেট । ইমা কেইথেল (মাদারের মার্কেট), যা ইমা মার্কেট বা নূপি কেইথেল (মহিলাদের বাজার) নামে পরিচিত, এটি ভারতের একমাত্র সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত বাজার । রাজু বললেন ” ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রম ব্যবস্থা, ললুপ-কাবা আরোপের পরে এই বাজারটি ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মণিপুরে ললুপ-কাবা একটি বাধ্যতামূলক শ্রম ব্যবস্থা ছিল যার ফলে মৈতেই সম্প্রদায়ের পুরুষ সদস্যদের দূর দেশে কাজ করা বা সেনাবাহিনীতে চাকরি করার প্রয়োজন ছিল। এই ব্যবস্থার ফলস্বরূপ, মহিলাদের তাদের জমি চাষ করে বা বস্ত্র বনন করে এবং পরে তা বাজারে পণ্য বিক্রি করে তাদের পরিবারকে সহায়তা করতে হয়েছিল। উন্নত বাজারগুলি ধীরে ধীরে সংগঠিত হয় ইমা কেইথেল গঠনের মাধ্যমে । বিংশ শতাব্দী অবধি ইমা কেইথেল মণিপুরের প্রাথমিক স্থায়ী বাজার ছিল। ১৮৯১ সালে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন মণিপুরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার আরোপের চেষ্টা করেছিল যা বাজারের কার্যকারিতা ব্যাহত করে। এই সংস্কারগুলির মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রশাসন মনিপুর থেকে ব্যাপক পরিমানে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য দ্রব্য রফতানি করে, স্থানীয় প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা না করে যার ফলে ঐসময়ে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এই ঘটনা ইমা কেইথেলের মহিলাদের আন্দোলনের দিকে পরিচালিত করেছিল এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশরা ইমা কেইথেলের সম্পত্তি বিদেশী এবং বহিরাগত ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল। ফলত এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত নূপি ল্যান বা মহিলা যুদ্ধের পরিণতি লাভ করে যা শেষ পর্যন্ত জাপানের বৃটিশ ভারত আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে অকালে শেষ হয়ে যায় । স্বাধীনতার পরে, বাজারটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং আর্থ-রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্র হিসাবে পুনরায় সুনাম অর্জন করে । ২০১০ সালে, বাজারটি ইম্ফল পৌর কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত খাওয়াইরামবন্দ বাজার কমপ্লেক্সে স্থানান্তরিত হয়।সেই থেকে এখনো পর্যন্ত এখানেই বাজারটা চলছে “।

” বাঃ , মনিপুরের নারীশক্তি র উপরে সম্ভ্রম ও ভক্তি দুইই বহুগুন বেড়ে গেল । আইরন লেডি ইরোম শর্মিলা বা অলিম্পিয়ান বক্সার মেরি কম এর নাম আগে শুনেছি ” বললাম আমরা , তার প্রত্যুত্তরে রাজু বলেন ” মনিপুরে ঘরে ঘরে ওরকম মেরি কম আছেন “ , ইমা মার্কেট এ ঢুকেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো , মনে হলো যেন কত বছর পিছিয়ে এসেছি । বড় বড় টীনের তোরঙ্গে করে টুকি টাকি হাজারো রকমের জিনিস নিয়ে এসেছেন মৈতেই বয়স্ক ও মাঝ বয়েসী মহিলারা । গামছা থেকে শুরু করে, ধুতি , চাদর , শাড়ি , মাফলার , সোয়েটার , শাল , মোজা , প্রসাধনী সামগ্রী , পিতল ও স্টেনলেস স্টীলের থালা , বাটি , গেলাস থেকে শুরু করে মায় রান্নার বিভিন্ন মশলা, সবজি , আনাজপাতি এবং বিভিন্ন রকমের ফল পর্যন্ত বিক্রি করছেন মহিলারা । পরনে বেশিরভাগের মৈতেই স্টাইলের পোশাক যাকে ফানেক বলে , সাথে ব্লাউজ ও দুপাট্টার মতন চাদর জড়ানো , কপালে তিলক কাটা , আর প্রায় সকলেরই এক মুখ পান । অদ্ভুত একটা মিশ্র গন্ধ নাকে পেলাম, ছোটবেলায় সন্ধ্যাকালে বাড়িতে ধুনো দেওয়ার সময় যে গন্ধ পেতাম অনেকটা সেরকম বা পুরোনো বই এর গন্ধের মতন । বেশ লাগছিলো পরিবেশটা । মাটি থেকে বেশ কয়েক ফুট উঁচু বেদিতে পর পর সবাই নিজ নিজ পসরা সাজিয়ে বসেছেন । কলকাতার সাউথ সিটি মল বা সিটি সেন্টারের পরিবেশ থেকে এ যেন শত যোজন দূরে । আড়ম্বরের বাহুল্য নেই , নামী ব্র্যান্ড এর চোখ ধাঁধানো উপস্থিতি নেই আছে শুধু এক রাশ আন্তরিকতা আর একেবারে মাটির ছোঁয়া । কত মানুষজন এসেছেন যে বলে বোঝাতে পারবোনা , ক্রেতা আর বিক্রেতার কোলাহলে চারিদিক মুখরিত । একটু ঘুরে আমরা এলাম এক মণিপুরী বৃদ্ধার দোকানে , খুব যত্ন করে তাঁর পসরা উনি দেখালেন । শাল, ধুতি, মাফলার এবং ঘর সাজাবার হস্তশিল্প কিছু কিনলাম আমরা । তারপর আবার ইতিউতি মার্কেটের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমরা । একজায়গায় দেখি মার্কেটের মধ্যে ছোট্ট মন্দির । দোকানিরা সেখানে পুজো দিচ্ছে বোধয় ভালো ব্যবসার আশায় । রাজু বললো “বাজারে ভেতরের এই মন্দির গুলিতে পূজিত হোন স্থানীয় দেবতা। স্থানীয় ভাষায় বলে কেইথেল লাইরেম্বী । যেকোনো আদি ধর্মের মতোই প্রাচীন স্থানীয় মণিপুরী ধর্ম হিন্দুধর্মের প্রসারের আগে গাছ, পাথর, আগুন, সূর্য , প্রভৃতি প্রকৃতির উপাসনার কথা বলতো , যা এখনো অনেক জায়গায় বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপাশি অনুশীলিত হয় ” ।এরপর এদিক ওদিক ঘুরে এলাম সবজি বাজারে , নানা বয়েসী মহিলারা বিভিন্ন মরসুমি শাকসব্জি ফল মূল বিক্রী করছেন ।

ইমা মার্কেট

গ্রাম বাংলার হাটের সাথে সাযুজ্য পেলাম কোথাও কোথাও , শুধু তফাৎ এই যে খোলা আকাশের নীচে কেনা বেচা না হয়ে ঢাকা জায়গায় । বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে বেশ কিছু হস্তশিল্প সামগ্রী ও শাল ইত্যাদি টুকিটাকি কিনে ফিরে এলাম প্রায় পাশেই অবস্থিত আমাদের হোটেল পোলোতে ।

এই হোটেল এ রিসেপশন এর সামনেই রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলাম, কিন্তু শুনলাম বেশ কিছুদিন ধরেই সেটা বন্ধ , সম্ভবতঃ পর্যটকদের অপ্রতুলতার কারণে ।এত সুন্দর সুন্দর সব জায়গা আছে এই মনিপুরে তথা উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে , তাও যে কেন মূলস্রোতের পর্যটনের ভীড় এ অঞ্চলে নিতান্তই নগণ্য সেটা আমাদের বোধগম্য হয়নি , হয়তো ভয়ের কারণে , হয়তোবা উপযুক্ত পরিকাঠামো , ভালো হোটেল, রাস্তাঘাট ইত্যাদির অভাব অনুমান করে , তবে এখানে এসে আমাদের মনে হয়েছে তার সবটাই বোধহয় সত্যি নয় । সব চিন্তাভাবনা সরিয়ে রেখে একটা পরিকল্পনা করে একবার এসে পড়লে দেখবেন উত্তরপূবের এই ভূস্বর্গ তার রূপ , রস , ইতিহাস , জীবনবৈচিত্র সবকিছু দিয়ে আপনাকে মোহিত করে রাখবে । পাঁচ তারা বিলাসবহুল পরিষেবার বাহুল্য দিয়ে নয় বরঞ্চ স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্যের পেলবতায় মণিপুর আপনাকে মুগ্ধ করবে । অন্য প্রসঙ্গে চলে এলাম – যাইহোক যেটা বলছিলাম , শুনলাম হোটেলে যারা থাকেন তাঁদের জন্যে ওনারা একই গ্রূপের অন্য হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে দেন । আমাদের বেলায়ও তাই হল , ঘরে ঢোকার ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া প্যাকেটে করে ভাত , ডাল, আলুভাজা ও মাছের ঝোল রুম সার্ভিস এ এলো, সাথে কাঁটাচামচ ও বোনচায়নার প্লেট । নিজেরাই বেড়ে নিয়ে খিদের পেটে তাই খেয়ে টানা ঘুম ।

পরেরদিন ওরাই সিম্পল ব্রেড বাটার জ্যাম, ওমলেট ও চা দিয়ে গেলো ব্রেকফাস্টে । স্নানাদি সেরে তাই খেয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে চেকআউট করে চললাম বহু প্রতীক্ষিত সেই পীঠস্থানে যেখানে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন । বিষ্ণুপুর জেলার মৈরাংয়ে আই এন এ মেমোরিয়াল । রাত্রিবাস করবো বিখ্যাত লোকতক লেকের পাশে , আর ঘুরবো কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্কে যা ড্যান্সিং ডিয়ার বা নাচুনে হরিনের জন্যে বিখ্যাত ।
ইম্ফলের পোলো হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে চেকআউট করেই আমাদের ট্যুর গাইড রাজুর তত্ত্বাবধানে স্করপিও চেপে চললাম লোকতাক লেকে । আজ রাত্রিবাস সেখানেই । শহরের এ রাস্তা সে রাস্তা পেরিয়ে শুরুতেই এসে পড়লাম নতুন গোবিন্দজি মন্দির ।

্নতুন গোবিন্দজী টেম্পল
নতুন গোবিন্দজী টেম্পল

দেবদর্শন করেই শুরু হবে আজকের ভ্রমণ । এই শ্বেত শুভ্র মন্দির মনিপুরে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত । শুনলাম জন্মাষ্টমী , রাস উৎসবের সময়ে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। প্রাতঃকালীন নিত্য পূজা ও আরতি তখন সবে শেষ হয়েছে । তাই বিগ্রহ দর্শন হলনা আমাদের কিন্তু এখানকার শান্ত সমাহিত ভাবগম্ভীর পরিবেশ আমাদের মোহিত করল । মূল মন্দিরের চূড়া সোনায় মোড়া । একটু পাশেই বাঁধানো পুস্করিণী আর তার পাশেই কারুকার্যখচিত প্রাচীন স্তম্ভের উপরে বৃহৎ এক ধাতব ঘন্টা দেখতে পেলাম । ঘন্টাধনি সহযোগে মনে মনেই গোবিন্দজির উদ্দেশ্যে ভক্তি সমর্পন করলাম আমরা , তারপর মনে এক রাশ ভালোলাগা নিয়ে ছুটে চললাম মৈরাংয়ে নেতাজী ধন্য আই এন এ মেমোরিয়াল দেখতে ।পথে পড়ল ইমফল পিস্ মিউজিয়াম ।

নতুন গোবিন্দজি টেম্পল
নতুন গোবিন্দজি টেম্পল ও ইম্ফল পিস মিউজিয়াম

জাপান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৯ সালে এটি নির্মিত হয় । ইমফল থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে রেড হিল অঞ্চলে শান্ত পরিবেশে এই নতুন ঝকঝকে মিউজিয়ামটি তৈরী হয় ইম্ফল যুদ্ধ বা ব্যাটল অফ ইম্ফল এর ৭৫ বছর পূর্তিতে । ১৯৪৪ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ইম্ফল ও কোহিমার আশেপাশের অঞ্চলে ব্রিটিশ-নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে সুভাষ চন্দ্র বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মির সাথে প্রায় সত্তর হাজার জাপানি সেনা মারা গিয়েছিল। এই যুদ্ধগুলির শেষ পর্বটি এই রেড হিলে লড়াই হয়েছিল । কল্পনা করলাম , যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার আসেপাশেই প্রায় ৭৫ বছর আগে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় । সেই মহাযুদ্ধে জাপান শোচনীয় ভাবে পর্যুদস্ত হয় কোহিমা এবং ইম্ফলে , যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নেতাজী তথা আই এন এ র ভাগ্যও এই যুদ্ধের ফলে সম্পূর্ণ অন্যদিকে মোড় নেয় । যে জাপান আর ইংল্যান্ড চির শত্রু ছিল এই যুদ্ধে, সেই জাপান ও ব্রিটিশ সরকারের বদান্যতায় এই ইমফল পিস্ মিউজিয়াম উদ্ভোধন হয় । তবে মিউজিয়াম তৈরীতে অর্থ সাহায্য আসে নিপ্পন ফাউন্ডেশন নামে জাপানের এক সংস্থা থেকে । এরপর হাঁটতে হাঁটতে এলাম ইন্ডিয়া পিস মেমোরিয়াল এ ।

ন্ডিয়া পিস মিউজিয়ামের ছবি

সরাসরি জাপান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয় ব্যাটেল অফ ইম্ফলের স্মৃতি তে । বড় বড় ফলকে দেখলাম বীর শহীদদের নাম খোদিত আছে।

ইন্ডিয়া পিস মিউজিয়াম

বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করে চললাম মৈরাংয়ে , যেখানে নেতাজী র স্মৃতি ধন্য আই এন এ মেমোরিয়াল রয়েছে । এখানেই নেতাজী প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন । এরপর নানা মফস্বল শহর গ্রাম পেরিয়ে বিষ্ণুপুর জেলার মৈরাংয়ে এসে পড়লাম আমরা । ভিতরে ভিতরে যথেষ্ট উত্তেজনা বোধ করলাম আমরা , কারণ এখানেই সেই পীঠস্থান যেখানে ১৯৪৪ সনের ১৪ ই এপ্রিল আজাদ হিন্দ ফৌজের পতাকা উত্তোলন করেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস । উত্তর পূর্ব ভারতের এই সব অঞ্চলে বৃষ্টির প্রকোপ খুব বেশী জানতাম কিন্তু তাই বলে শীতের ছুটির এই সময়ে যে বৃষ্টির সম্মুখীন হব তা কল্পনাও করিনি । বৃষ্টি মাথায় করে ছাতা মাথায় দিয়ে আই এন এ মেমোরিয়াল এ ঢুকলাম । পুরো কমপ্লেক্সে আছে একটি মিউজিয়াম , একটি লাইব্রেরী , অডিটরিয়াম , নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের একটি পূর্ণাবয়ব মুর্তি আর স্মৃতিফলকে মোড়া সেই বিখ্যাত স্থান যেখানে আজাদ হিন্দ এর পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয়। ছাতা মাথায় দিয়েই শুরুতে নেতাজী র স্ট্যাচু র সামনে অনেক ছবি ক্যামেরাবন্দি করা হল আর তারপর ঘুরে ঘুরে মিউজিয়ামের সব দ্রষ্টব্য দেখা হল । আমরা যেন হারিয়ে গেলাম সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে । আজাদ হিন্দ বাহিনী ও জাপানী সৈন্যের ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম প্রদর্শিত আছে এখানে আর আছে বেশ কিছু দুর্লভ ছবি , মানচিত্র । এক জায়গায় নেতাজী র সেই মহানিষ্ক্রমণের পথ ম্যাপ এ চিহ্নিত রয়েছে দেখলাম । সেই মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে মন টা কয়েক মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে গেল স্বাধীনতার প্রাক্কালে সেই সময়ে যখন ভারতের এইপ্রান্তে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে জাপানী সৈন্য ও আজাদ হিন্দের যৌথ বাহিনীর সাথে ব্রিটিশ দের । সেই যুদ্ধের ফলাফল উল্টো হলে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো , হয়তো বা পৃথিবীর ও । এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মিউজিয়ামে আজাদ হিন্দ বাহিনীর নানাবিধ দ্রষ্টব্য দেখে বেরিয়ে এলাম বাইরে সেই পীঠস্থানে যেখানে নেতাজী প্রথম ভারতের তিরঙ্গা উত্তোলন করেন । একটু লাইব্রেরীতে এলাম এরপর । এক স্থানীয় মধ্যবয়স্ক মহিলা দেখলাম গভীর মনোযোগ সহকারে বেশ কিছু বই থেকে নোট গ্রহণে ব্যস্ত , হয়তো বা নেতাজী কে নিযে গবেষণায় নিমগ্ন ।

আই এন এ মেমরিয়াল ও সেন্ড্রা রিসোর্ট লোকতাক লেক


আই এন এ মেমোরিয়াল থেকে বেরিয়ে এরপরে অতি সংক্ষিপ্ত সফরেই চলে এলাম বিখ্যাত লোকতাক লেকের পাশে । আমার কন্যার কৌতুহলী প্রশ্ন “বাবা, এটা কি সমুদ্র ?” সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম সত্যি ই এক সুবিশাল জলরাশির পাশে এসে পড়েছি আমরা যার এপার ওপার দেখা যায়না । মাঝখানে একটা ব্রীজ মতন অংশ পেরিয়ে সোজা চলে এলাম সেন্দ্রা রিসর্ট এ । আজ এখানেই রাত্রিবাস ।

সেন্ড্রা রিসোর্ট থেকে লোকতাক লেক দর্শন

প্রথম দর্শনেই এই অনবদ্দ্য নিরালা প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত এই রিসর্ট আমাদের মুগ্ধ করল । ছোট ছোট কটেজ চারিদিকে ছড়ানো লেকের ধার ঘেঁষে , লাগেজ নিয়ে এরকম একটি কটেজে এলাম আমরা যা আমাদের জন্যে নির্ধারিত ছিল । আহা কতদিনের সাধ ছিল এরকম বাংলো তে গাছ পালা নদী নালা পরিবৃত পরিবেশে ক’টাদিন অবসর যাপন করব । তা ক’টা দিন না হোক অন্তত একটা দিন তো এই কটেজ , এই প্রকৃতি পুরোপুরি চেটেপুটে উপভোগ করি । দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুম , পাশেই বাথরুম সহ বেশ আরামদায়ক এক বেডরুম , ড্রয়িং রুম এর কোন দিয়ে কাঠের বার্নিশ করা ঝকঝকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায় কাঠের পালিশ করা মেঝে আর সামনে দেওয়াল জোড়া কাঁচ যুক্ত একটি ঘরে । সেখানেও মেঝেতে গদি মোড়া দুটি বিছানা পাতা । ঘরের মূল আকর্ষণ সামনের দেওয়াল জোড়া কাঁচ পেরিয়ে দৃশ্যমান লোকতক লেক । আমার কন্যা তো এরকম বাংলো পেয়ে যারপরনাই পুলকিত । ” বাবা , আমি এখানেই শোবো আর লেক দেখবো ” , ওর দাবি । সমগ্র পরিবেশ আর এই কটেজের সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় এতটাই মোহিত ছিলাম আমরা যে দ্বিপ্রাহরিক আহারের কথা ভুলেই গেছিলাম । সম্বিৎ ফিরল মেয়ের ডাকে ,” বাবা খিদে পেয়েছে” । ঘর বন্ধ করে হুড়মুড় করে ছুটে চলে আসি সেন্দ্রা রিসর্টের রেস্তোরাঁয় । ফ্রায়েড রাইস আর চিকেনের অর্ডার দিয়ে কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে বাইরের দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল । যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু জল । মেঘলা আকাশ হওয়ার জন্যে দূরের কিছু দেখা যাচ্ছেনা । জলের মধ্যে মধ্যে বড় বড় ঘাসজমি ভেসে বেড়াচ্ছে , এগুলোকে বলে ফুমদি । গুল্মজাতীয় গাছ , ঘাস , অন্যান্য জৈবপদার্থ ও মাটি দিয়ে এই ফুমদি তৈরী হয় । ঝটপট লাঞ্চ সেরে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম বিখ্যাত কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক দেখতে । এই জাতীয় উদ্দ্যানটি পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান ন্যাশনাল পার্ক । মনিপুরের জাতীয় পশু সাঙ্গাই হরিণ বা ডান্সিং ডিয়ারের জন্যে এই পার্ক বিখ্যাত । আমাদের গাইড রাজুর কাছে শুনলাম বিগত কয়েক বছর ধরে এই পার্কে ফুমদির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে , তার কারণ হিসেবে রাজুর বক্তব্য মূলত ন্যাশনাল পার্কের অনেক কাছাকাছি পর্যন্ত কৃষিজমি ও বাসস্থানের দখল । মানুষের নিরন্তর লোভ কিভাবে যে বিশ্বপ্রকৃতির ধ্বংস করছে তা পৃথিবীর যেখানেই গেছি সেখানেই দেখতে পেয়েছি । সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে যে কি পরিমান উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্রের ক্ষতি হয়েছে তা বলে বোঝানো যাবেনা । একটু বাদেই আমাদের স্করপিও এসে পৌঁছলো কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্কের গেট এ । টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম জাতীয় উদ্যানে ।
প্রায় ২৩৩ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ , ৪০০ প্রজাতির প্রাণী এবং ১০০ প্রজাতির পাখি নিয়ে এই ভাসমান জাতীয় উদ্দ্যান- প্রায় ৪০ বর্গ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত । আমাদের স্করপিও সন্তপর্ণে সংকীর্ণ জঙ্গল পথে এগিয়ে চললো । এক জায়গায় উল্টোদিক থেকে আসা একটি মারুতি কে সাইড দিতে গিয়ে আমাদের গাড়ী পাশে ঢালু জমিতে কাত হয়ে পড়লো । দক্ষ চালক ইরফান সহ আমরা অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি থেকে নেমে অনেক ঠেলাঠেলি করেও পুনরায় বামদিকের চাকা দুটি মূল রাস্তায় তুলতে অক্ষম হলাম । ততক্ষনে মারুতি থেকে নেমে অল্প বয়েসী স্থানীয় চালক ছেলেটিও চলে এসেছে আমাদের পাশে । ছেলেটিও অপ্রস্তুত; ওকে পাশ দিতে গিয়ে আমরা যে ফেঁসে যাবো তা ও বোঝেনি । ইতিমধ্যে অন্ধকার ও হয়ে আসছে । বেশ বুঝতে পারলাম আজ বিকেলের এই জঙ্গল সফর ভেস্তে গেলো । শেষ মেশ ওই ছেলেটি ও গাড়ীতে বসা ওঁর সঙ্গিনী ই আমাদের লিফ্ট দিল সেন্দ্রা রিসোর্ট অব্দি । কথা হলো আমাদের গাড়ী ক্রেন দিয়ে তুলে তারপরেই রাজু আর ড্রাইভার ইরফান রিসোর্টে ফিরবে ।

প্রথম দিনে কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান

মন খারাপ করে ঘরে ফিরলাম , কিন্তু দোতলার ঘরে এসেই দেওয়াল জোড়া কাঁচ দিয়ে বাইরের লোকটাক লেকের দৃশ্য দেখে মুহূর্তের মধ্যে মন খারাপ উবে গেলো । গোধূলি কালের সেই অপার্থিব দৃশ্য যেন কোনো জাপানী চিত্রকরের হাতে আঁকা জলছবি । ধীরে ধীরে দেখলাম হ্রদের বুকে সন্ধ্যে নামলো । রাজু আর ইরফান গাড়ী ঠিক করে ততক্ষনে চলেও এলো । রাজু জানাল যে কাল সকালে আবার কেইবুল লামজাও পার্ক যাওয়া হবে । রুম সার্ভিসেই এরপর ডিনার এলো । ডিনার শেষে একতলার আরামদায়ক বেডরুমে কম্বল মুড়ি দিয়ে টানা ঘুম ।
ভোরবেলা নানাবিধ পাখীর কিচির মিচির ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো , জানালার ভারী পর্দা সরাতেই বাইরে মেঘাছন্ন লোকতক লেকের দৃশ্য ভেসে উঠল । চটজলদি ক্যামেরা ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম । সামান্য একটু উপরে ভিউ পয়েন্টে উঠে চোখ জুড়িয়ে গেল ।

সেন্ড্রা রিসোর্ট থেকে দেখা লোকতাক লেকের অসামান্য দৃশ্যের ছবিগুলি দেখুন

হালকা একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে আর লোকতক লেকের স্নিগ্ধ রূপ যেন মোহিত করে রেখেছে , কুয়াশা আর মেঘের ঘোমটার আড়াল থেকে সে যেন মাঝে মাঝে উঁকি মারছে । অদ্ভুত এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে মনটা ভরে গেল । দেশে বিদেশের অসংখ্য লেকের দৃশ্য আমরা দেখেছি কিন্তু লোকতক লেকের সৌন্দর্যের যা ব্যাপ্তি দেখলাম এই সকালে তার সাথে কারুর ই কোনো তুলনা চলেনা ।

পরেরদিন ভোরবেলায় সেন্ড্রা রিসোর্ট থেকে দেখা লোকতাক লেকের দ্রশ্য

এরপর ঝটপট ব্রেকফাস্ট সেরে চেকআউট করে আবার চললাম গতকালের অসমাপ্ত জাতীয় উদ্দ্যান দর্শনে । কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্কের গেট থেকে ভেতরে ঢুকে মনে হলো আজ পর্যটকদের গাড়ীর সংখ্যা বেশ বেশী । ধীরে ধীরে স্করপিও উপরের টিলায় উঠে এলো , ওখানে একটা ওয়াচ টাওয়ারের থেকে সামনের বিস্তীর্ণ ভাসমান জমি বা ফুমদি দেখা যাচ্ছিল । বনদপ্তরের উদ্যোগে ওখানে বাইনোকুলার রাখা ছিল । তাই দিয়ে বেশ অনেক্ষন ধরে খোঁজার চেষ্টা করলাম আমরা বিখ্যাত সাঙ্গাই হরিণ বা নাচুনে হরিণ । বহুক্ষণের চেষ্টায় গাইড রাজু বাইনোকুলারের পজিশন ঠিক করে সামনে ঘাসজমির আড়ালে সাঙ্গাই হরিণ ট্র্যাক করতে সক্ষম হল । আশেপাশের অন্যান্য পর্যটকরা তাই দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাইনোকুলারের উপর । যেন দেবদর্শন হলো ।

কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্দ্যানের ছবি দেখুন

দ্বিতীয় দিন কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান সফর

আমার অবশ্য সাঙ্গাই হরিণ খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতন পাওয়া গেলো কি গেলো না তাই নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই – এই অনবদ্য জঙ্গুলে পরিবেশে দিগন্ত বিস্তৃত ভাসমান ঘাসজমি দেখতে দেখতে মনটা হালকা বয়ে যাওয়া হওয়ার মতোই যেন কোথায় হারিয়ে গেলো । আমার এবং আমার স্ত্রী এর এই এক সমস্যা , জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে দেবদর্শনের মতন জীবদর্শন কেই একমাত্র সাধনা হিসেবে ভাবতে আমরা পারিনা , বরং জঙ্গলের প্রাকৃতিক পরিবেশ , তার রূপ রস গন্ধ স্পর্শ সব কিছু নিয়ে সে আমাদের মুগ্ধ করে । ইচ্ছা ছিল আরো কিছুক্ষন এই জায়গায় কাটাই , কিন্তু রাজুর তাড়ায় ফিরে আসতে হল গাড়ীতে আর তারপর চলে এলাম মূল লোকটাক লেকের পাশে ।
দেখি সারি সারি বোট দাঁড়িয়ে আছে পর্যটকদের বোটিং করাবার জন্যে । টিকিট কেটে উঠে বসলাম তার একটাতে । ঠিক হল আমরা প্রথমে যাব লেকের মাঝখানে এক ভাসমান জমিতে যেখানে একটি মনিপুরী পরিবার বসবাস করেন ও একটি হোমস্টে চালান । তারপর লেকটা একটু ঘুরে আবার ফিরে আসবো । সেইমত ছবি তুলতে তুলতে লোকতাক লেকের টলটলে ঘন নীল জল কেটে এগিয়ে চললাম আমরা । কি অপূর্ব যে শোভা সেই হ্রদের তা আমার পক্ষে ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয় ।দূষণমুক্ত পরিবেশে ঝকঝকে নীল আকাশ , আকাশে ভেসে বেড়ানো পেঁজা তুলোর মতন সাদা মেঘ ,ঘন নীল লোকতাকের জল , ইতিউতি জলে ভেসে বেড়ানো ভাসমান ঘাসজমি , আর সর্বোপরি অক্সিজেন পরিপূর্ন বিশুদ্ধ বাতাস , সবমিলিয়ে ঘোর লেগে গিয়েছিল ।

লোকতাক লেক ভ্রমনের ভিডিও

ঘোর কাটলো বোট চালকের কথায় , ” স্যার , উও দেখিয়ে হামলোগ ফ্লোটিং হাউস কা সামনে চালে আয়ে ” । দেখি স্পীড বোট টা স্টার্ট বন্ধ করে আস্তে আস্তে সামনের ভাসমান ঘাসজমিতে এসে নোঙ্গর করল ।

একটি অল্পবয়েসী মণিপুরী ছেলে , নাম তার অংগাম্বা , এসে আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলো ফ্লোটিং হোমস্টে কাম রেস্তোরাঁয় । এই ছেলেটিই তার পরিবার নিয়ে থাকে এই ভাসমান জমিতে আর এই হোমেস্ট চালায় । বেশ ছিমছাম দুটি ঘর আছে দেখলাম । মেঝেতে মোটা গদিতে বিছানা পাতা , মশারি ও টাঙানো , বুঝলাম মশার বেশ উপদ্রব আছে এখানে । দুটি ঘর ই ফাঁকা ছিল , কোনো পর্যটক ছিলেন না , তাই অংগাম্বা ঘুরে ঘুরে আমাদের তার ব্যবস্থাপনা দেখালো । কল্পনা করলাম এক রাত এই ভাসমান ঘরে , এই সুনীল জলরাশি পরিবৃত নিভৃত ভূখণ্ডে , লোকালয়শূন্য স্থানে , এক গ্রাম্য মৈতেই পরিবারের সাথে কাটালে কেমন অভিজ্ঞতা হবে , সেই অভিজ্ঞতা নিশ্চই সারাজীবন সঞ্চয় করে রাখার মতোই । ভাসমান এই ঘরে বিছানায় শুয়ে বাইরের বিস্তীর্ন লোকটাক হ্রদের বুকে প্রতিফলিত জ্যোৎস্নার শোভা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া আর পরেরদিন নানবিধ পাখীর ডাকে ঘুম ভাঙার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই হবে অনন্য । আফসোস করলাম লোকতাকে মাত্র এক রাত থাকার পরিকল্পনা করার জন্যে । আগে থেকে জানা থাকলে এক রাত সেন্দ্রা রিসর্ট আর এক রাত বিস্তীর্ণ হ্রদের মধ্যিখানে এই দ্বীপভূমি তে কাটাতাম । যাইহোক ঘোর কাটলো অংগাম্বার কথায় , “ সাব , চলিয়ে আপলোগ পাস মেই মেরা ঘর চলিয়ে ” । নড়বড় নড়বড় করতে করতে একটু দুলতে দুলতে এলাম পাশেই অংগাম্বা র আবাসস্থলে । দেখলাম সেই ছোট্ট ভূখণ্ডে পাশাপাশি দুটো কুঁড়ে ঘর । একটি রান্না ঘর আর অপরটি বড় একটা শোবার ঘর । অংগাম্বার দুই বাচ্চা , একটি ছেলে ও মেয়ে সেখানে খেলছে । ঋতু , আমার স্ত্রী প্রশ্ন করল ” আপকি বিবি কাঁহা হ্যায় ? ” । ” উও তো ফিসিং কে লিয়ে বোট লেকে গায়ি হায় ” । শুনলাম এই হোমস্টে র ব্যবসা ছাড়াও ( সেটাও অনিশ্চিত , পুরোপুরি পর্যটকদের আনাগোনা নির্ভর ) মাছধরাই এদের প্রধান জীবিকা । এই বিস্তীর্ন হ্রদের মাঝে সেটাই তো হওয়া স্বাভাবিক । গৃহকত্রী বাইরে জীবিকা নির্বাহ করতে গেছেন , কর্তা অংগাম্বা ঘরকন্না , রান্নাবান্নার কাজ করছেন আর বাচ্চারা এক মুখ হাসি নিয়ে খেলে যাচ্ছে এই দিগন্ত বিস্তৃত হ্রদের মাঝে একটুকরো ঘাসজমি বা ফুমদি তে । বড় ভালো লাগলো এদের সরল সাদাসিধা গ্রাম্য জীবনযাত্রা দেখে ।

লোকতাক লেকে ভাসমান দ্বীপে গ্রাম্য জীবনযাত্রার ভিডিও

অনেক্ষন এখানে কাটিয়েছিলাম বলে বোধয় ঘড়ির দিকে সদাসতর্ক দৃষ্টি রেখে চলা শ্রীমান রাজুর তাড়া লেগে গিয়েছিল । রাজুর তাড়ায় তাই আবার ফিরে চলি বোটে । আমাদের যে ফিরতে হবে পাড়ে , ” সভ্যজগতে ” ।
ফিরতি পথে লোকতাক লেকের অন্য অংশ দিয়ে ফিরলাম । ফেরার পথে দেখলাম বড় বড় জাল ফেলে মাছ ধরা চলছে । এক জায়গায় দেখি খড় ,বাঁশ , শুকনো ঘাস ইত্যাদি দিয়ে জলের মধ্যে বেড়া দিয়ে ঘিরে এই সুবিশাল হ্রদের মধ্যে যেন আরেকটা ছোট হ্রদ বানানো হয়েছে । রাজু কে প্রশ্ন করাতে বলে ওটা ফিসপন্ড – মাছচাষের জায়গা ।রাজুর কাছেই শুনলাম এককালে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত এই লেকে । কিন্তু বর্তমানে লোকটাক লেকে ইথাই বাঁধ প্রকল্পের ফলে ও মাত্রাতিরিক্ত জলদূষণের কারণে মাত্র ৩৮ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় ।পেঙবা মাছ মণিপুরের ইন্ডিজেনাস ফিশ গোষ্ঠীর মধ্যে পরে এবং এটি এই প্রদেশের স্টেট ফিশ । শুনে খারাপ লাগলো যে সেই পেঙবা মাছ এখন অবলুপ্ত প্রায় । এই ভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে সভ্যতার নিষ্ঠুর অগ্রগতির পরিনাম কিন্তু ভোগ করতেই হবে পরবর্তী প্রজন্মগুলিকে । গত প্রজন্মের মাছ ধরার পদ্ধতিও এখন প্রায় অবলুপ্তপ্রায় । বেতে বোনা একধরণের ঝুড়ি . ফিশিং রড , ফিশিং হুক ইত্যাদি দিয়ে আগেরকারদিনে মাছ ধরার প্রচলন ছিল । সেই প্রথাও এখন নেই । এইভাবে প্রাচীন রীতিনীতি , সংস্কৃতি সব হারিয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে । টংব্রাম অমরজিৎ সিং নামে এক স্থানীয় ভদ্রলোক এই মৎস্য চাষ ও ফিশিং সংক্রান্ত এই সমস্ত অবলুপ্তপ্রায় প্রচলিত পদ্ধতি প্রদর্শনের জন্যে আস্ত একটি জাদুঘর বানিয়ে ফেলেছেন এই লোকতাক অঞ্চলের থাংগা গ্রামে, লোকতাক ফোকলোর মিউজিয়াম নামে যেটি পরিচিত । সময়ের অভাবে সেখানে যাওয়া হলনা ।

লোকতাক লেকে জলযাত্রার ভিডিও

লোকতাক লেক জলজাত্রার ছবিগুলি দেখুন

রাজুর ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে কখন যে আবার জেটি তে ফিরে এলাম , বুঝতেই পারলাম না । ভারী সুন্দর এক আমেজ নিয়ে সাথে অনেকটা অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে আবার এগিয়ে চলি মণিপুরের অন্নপ্রান্তে । এবারের গন্তব্য বার্মা বা মায়ানমার সীমান্তে মোরে শহর , সেখানে থাকবো এক রাত । পরের দিন যাবো বার্মার সীমান্ত শহর তামু । ওখানে যেতে পাসপোর্ট বা ভিসা লাগবেনা – শুনলাম ভারতীয় পরিচয়পত্র ভোটার আইডি কার্ড বা আধার কার্ড থাকলেই হবে । একরাশ উত্তেজনা নিয়ে লোকতাক লেক কে বিদায় জানিয়ে রওয়ানা হলাম মোরে র উদ্দেশ্যে।


( পরের পর্ব আগামী সংখ্যায়ে )

4 Comments

  1. Indra

    Durdanto!

  2. Indra

    Durdaanto! Aaro chaii

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *