চিত্রাঙ্গদার দেশে – পার্বত্য মণিপুর উখ্রুল

লেখা- তীর্থ দাশগুপ্ত ,  ছবি – ঋতু দাশগুপ্ত , অলঙ্করণে – কৌশিক চক্রবর্তী

৩০ শে ডিসেম্বর সকালে প্রাতরাশ সেরে উঠে বসলাম স্করপিওতে । আজকের গন্তব্য পার্বত্য মণিপুরের উখরুল । প্রথমেই বেশ কিছুটা সমতলের উপর দিয়ে গাড়ী ছুটল । ইমফল শহর পেরিয়েই রাস্তার দুপাশে ফাঁকা চাষের জমি । রাজুর ধারাবিবরণীও চালু হয়ে গেল আগের মতন । রাজুর থেকেই জানলাম মণিপুরের প্রধান অধিবাসী মৈতেইরা মূলতঃ এই বিস্তীর্ণ সমতলে বা উপত্যকায় বসবাস করেন আর যেখানে আমরা যাচ্ছি সেই পার্বত্য মণিপুরে মূলতঃ আদিবাসী বা ট্রাইব্স দের বাস ।

এই আদিবাসীরা আবার দুধরনের , নাগা ও কুকী । নাগা আদিবাসীরা আবার অনেক উপজাতিতে বিভক্ত যেমন আনল, লিয়াংমাই, মাও, মারাম, মেরিং, পাইমাই, রঙ্গমেই, তাংখুল, জেম, ইত্যাদি । তারমধ্যে তাংখুল নাগারাই মোটামুটি বিখ্যাত । উখরুল মূলতঃ তাংখুল নাগা অধ্যুষিত অঞ্চল ।
” উখরুলে প্রবেশ করার বেশ খানিকটা আগেই আমরা যাবো হুনদুং গ্রামে যেখানে তাংখুল নাগারা তাদের প্রাচীন জীবনযাত্রা , আচার ব্যবহার ইত্যাদি অনেকটাই বজায় রেখেছে । হুংদুং গ্রামের প্রধানের সাথে আলাপচারিতা হবে তাঁর বাড়িতেই । জানতে পারবেন তাদের অনেক ইতিহাস ।” বললেন রাজু । শুনেই বেশ একটা রোমাঞ্চ হল ।
একটু বাদেই সমতল ছেড়ে গাড়ী পাহাড়ী রাস্তায় উঠল । সরু রাস্তা , পাশে গভীর খাদ আর একদিকে ঘন জঙ্গল ।

Way to Ukhrul
উখ্রুলে যাওয়ার পথের দৃশ্য

চারিদিকে ঘন সবুজ । রাস্তায় গাড়ী ঘোড়া বেশ কম । নাকে একটা অদ্ভুত মিশ্র বুনো গন্ধ আসতে লাগলো । ঠান্ডা হাওয়া মুখে হালকা ঝাপ্টা মারছিল । রাস্তার দুপাশে একটু বাদেই দেখি হলুদ, গোলাপি বুনো ফুলের বাহার । বেশ খানিকটা সর্পিল পথ পেরিয়ে একটা গ্রাম পেলাম । শুনলাম এটা কুকি আদিবাসীদের গ্রাম । রাজুর কাছেই শুনলাম এই কুকি আদিবাসীরা কয়েকশো বছর আগে তিব্বত ও বার্মা থেকে এসে অরুণাচল প্রদেশ ছাড়া প্রায় সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পরে ।


এই কুকিদের প্রচুর রীতিনীতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সোম বা সাওম । এই সাওম হল ছেলেদের সম্প্রদায়ের কেন্দ্র – কম বয়েসী ছেলেরা সকলে একসাথে এখানে থাকত আর শিক্ষালাভ করত , ব্যবহারিক শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে জীবনেরও শিক্ষা । সাওম ছিল শিক্ষার কেন্দ্র যেখানে সাওম-আপ (একজন প্রবীণ শিক্ষক ) শিক্ষাদান করতেন এবং সাওম -নু ছেলেদের চুল আঁচড়ানো, পোশাক ধোওয়া এবং পোশাক তৈরি করার মতো অন্যান্য কাজকর্মের যত্ন ও উদ্যোগ নিতেন ।সেরা শিক্ষার্থীদের রাজা বা প্রধানের সেবার জন্য সুপারিশ করা হত এবং শেষ পর্যন্ত তারা আদালতে সেমং এবং পাচং (মন্ত্রী), বা সেনাবাহিনীতে গ্যাল – লামকাই (নেতা, যোদ্ধা) হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করত ।

আরেকটি হল লম বা লাওম । এটি একটি ঐতিহ্যবাহী যুব ক্লাব । এটি এমন একটি সংস্থা যেখানে ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের সুবিধার জন্য সামাজিক ক্রিয়ায় লিপ্ত হত । প্রতিটি লাওম এ এক জন লাওম -আপ (সিনিয়র সদস্য), এক জন তোল্লাই – পাও (অধ্যক্ষ বা সুপারিন্টেন্ডেন্ট) এবং এক জন  লাওম – তাংভ (সহকারী সুপারিনটেন্ডেন্ট) থাকত । ঐতিহ্যবাহী শিক্ষার উৎস হওয়ার পাশাপাশি লাওম প্রতিষ্ঠানটি তার সদস্যদের প্রযুক্তিগত এবং ব্যবহারিক জ্ঞান উভয়ই সঞ্চারিত করত বিশেষত কৃষিকাজ, শিকার, মাছ ধরা এবং ক্রীড়া সম্পর্কিত পদ্ধতি সম্পর্কে। বিভিন্ন প্রকারের ক্রীড়া কার্যক্রম যেমন হাই জাম্প , সুতমুমখাওয় বা একধরণের জ্যাভেলিন থ্রো , সোংসে বা শট পুট ইত্যাদি শেখানো হত।

Way to Ukhrul1
উখ্রুলে যাওয়ার পথে কুকী গ্রাম


লাওম এমন একটি কেন্দ্র ছিল যেখানে তরুণ কুকিরা শৃঙ্খলা ও সামাজিক শিষ্টাচার শিখতেন। শুনলাম এখনকার দিনেও ফসল কাটার মৌসুমের পরে, লাওম – সেইল উৎসব উদযাপিত হয় এবং উৎসবের স্মারক হিসেবে একটি স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের সাথে নাচ এবং রাইস -বিয়ার পান করা হয় যা মাঝে মাঝে সারাদিন সারারাত ধরে চলে । রাজুর মুখে কুকিদের জীবনযাত্রার এই কাহিনী শুনতে শুনতে যেন এক অন্য পৃথিবীতে চলে গেছিলাম । সত্যি তো বিশাল এই ভারতের কতরকম জনজাতি , কতরকম তাদের ঐতিহ্য , রীতিনীতি । কতটুকুই বা আমরা জানি বা জানার চেষ্টা করি । সত্যি কথা বলতে কি , এরাই তো ভারতের আসল জন-জাতি ।

কুকী দের গ্রাম পেরিয়ে আবার অনেকটা পাহাড়ী পথ এঁকে বেঁকে চলা । এরপর রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম হুনদুং গ্রাম চলে এসেছি । গাড়ীটা এরপর মূল রাস্তা ছেড়ে ভেতরে মেঠো পথ ধরলো আর একটু চড়াইয়ে উঠলো । উঠেই বেশ খানিকটা সমতলভূমি , কয়েকটা কাঠের বাড়ী , কারুকার্য খচিত , কাঠের উপরে নানাধরণের মুখ ও চিহ্ন খোদাই করা । রাজু সামনেই একটা পাথরের সিঁড়িপথ দেখালেন । ওটাই উঠে গেছে গ্রামপ্রধান বা চীফের বাড়ী । আমরা যাবো ওখানে । কয়েকধাপ উঠেই চলে এলাম গ্রামপ্রধানের বাড়ীর উঠোনে । না বলে কয়ে হুট্ করে এরকম সম্মানীয় ব্যক্তির বাড়ী দেখা করতে আসায় একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো , কিন্তু সেই সব দ্বিধা দ্বন্দ কেটে গেলো ভিলেজ চীফের পত্নীর একমুখ হাসি নিয়ে আন্তরিক অভ্যর্থনায় । বুঝলাম রাজু এখানে পরিচিত মুখ, আগেও বেশ কয়েকবার ট্যুরিস্ট নিয়ে এখানে এসেছেন । অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এই ভদ্রমহিলা দেখলাম খুব ই আন্তরিক এবং আলাপী । একটু বাদেই বাড়ীর থেকে বেরিয়ে এলেন ভিলেজ চীফ । সাথে ওনাদের ছোট মেয়ে । চেয়ার পেতে বাড়ীর উঠোনে বসতে দিলেন । রাজু আমাদের আলাপ করিয়ে দিলেন চীফের সাথে । ইনি হলেন এই হুনদুং বা হুংপুং রাজপরিবারের বংশধর । কলকাতা থেকে এতদূর এই তাংখুল নাগা গ্রামে ঘুরতে এসেছি শুনে যারপরনাই উৎসাহিত হলেন । বেশ ভালো ইংরেজি বলেন উনি তাই কথাবার্তা ইংরেজিতেই হতে থাকলো । কথাবার্তায় ও আচরণে আভিজাত্যের লক্ষণ ফুটে বেরোচ্ছে । হটাৎ “আরণ্যকের ” দোবরু পান্না বির্বরদী র কথা মনে পড়ে গেল । ইতিমধ্যেই সবার জন্যে শরবত নিয়ে এলেন প্রধানের স্ত্রী তথা রানীমা ।

রাজার সাথে আলাপচারিতায় জানলাম যে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে মণিপুর রাজপরিবারের সদস্যগণ অনেক শতাব্দী পূর্বেই হাংপুং গ্রাম থেকে উপত্যকায় নেমে আসেন ও বহু শতাব্দী ধরে এই গ্রামের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেন । প্রাচীন কালে এই হাংপুং রাজপরিবার তার সার্বভৌমত্বের অধীনে ছোট ছোট গ্রামগুলিকে বাহ্যিক আগ্রাসনের হাত থেকে সুরক্ষা দিত।

হাংপুং রাজ পরিবারের বিশালত্ব, উদারতা এবং আতিথেয়তার কোন তুলনা ছিলনা । তাংখুল নাগা এবং মৈতেই গণ একই মায়ের দুই সন্তানের মতন , একদল থেকে গেলেন এই পার্বত্য অংশে , আরেকদল রাজ্যপাট বসালেন বিস্তীর্ণ উপত্যকা অঞ্চলে । এই দুই অধিবাসীদের মধ্যে ভালবাসা, শান্তি, বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কের উদযাপন করার জন্যে , ‘ইরোই থাবা’ (একটি ‘মহিষ’ মুক্তি) নামক এক প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ উৎসব পালন করা হয় । তিনি বলেন, ” এই উৎসব মণিপুর মহারাজা এবং থাইভাইও হাংপুং প্রধানের মধ্যে ১৯৯২ অবধি প্রচলিত ছিল, যার মাধ্যমে হাংপুং গ্রাম থেকে একটি মহিষ ছেড়ে দেওয়া হতো এবং দুই গোষ্ঠীর মানুষের দীর্ঘায়ু এই মহিষের সুস্থতার উপর নির্ভর করে নির্ণীত হতো । ” চীফ আরও বললেন তিনি চান যাতে উপত্যকায় বসবাসকারী মৈতেই বৈষ্ণবদের সাথে পাহাড়ে বসবাসকারী ” হাও ” ধর্ম পালন করা এই তাংখুল নাগা অধিবাসীদের সাথে প্রাচীন সম্পর্কের বন্ধন আরো দৃঢ় হয় । জিজ্ঞাসা করি “হাও ” কোন ধর্ম ? চীফ বলেন ” হাও হচ্ছে ঠিক সংগঠিত ধর্ম নয় , বরং এটা হল animism ।

অ্যানিমিজম কথাটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ অ্যানিমি থেকে যার মানে ‘ শ্বাস, আত্মা, বা জীবন’ । এটি একটি প্রাচীন বিশ্বাস যেখানে মানুষ মনে করত যে পৃথিবীর সমস্ত বস্তু, স্থান এবং সকল প্রাণীই একটি পৃথক আধ্যাত্মিক সারমর্মের অধিকারী । এই animism এ বিশ্বাসী মানুষরা সকল প্রাণী, গাছপালা, পাথর, নদী, আবহাওয়া ব্যবস্থা, মানুষের হাতের কাজ এমনকি মুখে কথা বলা শব্দগুলিকেও অ্যানিমেটেড বা জীবিত হিসাবে উপলব্ধি করে। ধর্মের নৃতাত্ত্বিকতা অনুযায়ী প্রাচীনকালে অ্যানিমিজমটি বহু আদিবাসী মানুষের বিশ্বাস ব্যবস্থার অঙ্গ ছিল । ক্রমশঃ খ্ৰীষ্টান ধর্মের প্রভাবে এই ” হাও ” আস্তে আস্তে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায় । এখন এখানে সবাই প্রায় খ্রিস্টান । ”

মনে মনে ভাবলাম সভ্যতার অগ্রগতির সাথে না জানি কত প্রাচীন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট , সমাজ ব্যবস্থা , ধর্ম ব্যবস্থা , বেশ ভূষা , ইত্যাদি হারিয়ে যাচ্ছে । পরবর্তী প্রজন্ম তো এসব কোনোদিন জানতেও পারবেনা । কল্পনা করলাম পশ্চিমী দেশ হলে এই হুংদুং গ্রামেই বেশ বড়সড় একটা ওপেন এয়ার মিউজিয়াম বানাতো এই তাংখুল নাগাদের প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা জীবনযাত্রা ইত্যাদি পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার জন্যে অথচ এখানে সেসব কিছুই নেই । একজন ও পর্যটক এখানে নেই , আসেন ও না হয়তো কেউ ।

হুংদুং রাজের বংশধর তথা এই ভিলেজ চীফের সাথে আলাপচারিতায় কেটে গেল অনেকখানি সময় । মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাংখুল নাগাদের জীবনযাত্রা , ইতিহাস , সংস্কৃতি ইত্যাদির বিবরণ শুনতে শুনতে কোথা দিয়ে যে দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেলো টের পেলাম না । এরপরে রাজপরিবারকে বিদায় জানিয়ে চললাম উখরুলের উদ্দেশ্যে আর খানিক্ষণের মধ্যেই চলে এলাম উখরুল শহরে । তাংখুল নাগা আদিবাসীদের বাসস্থান উখরুল জেলার সদর এই উখরুল শহর ।

বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট , দোকানবাজার , রেস্টুরেন্ট , ব্যাংক , অফিস কাছারী ইত্যাদি নিয়ে বেশ সুন্দর ছিমছাম পাহাড়ী শহর প্রথম দর্শনেই মন কাড়লো । শহরের ভিতর দিয়ে এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে রাজু আমাদের এরপর নিয়ে এলো স্থানীয় একটি হোটেল কাম রেস্তোরাঁ এ । মোমো আর কফি সহযোগে লাঞ্চ সারা হল আর তারপর এসে চেক ইন করলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেল ” হোটেল শালোম ” এ । বেশ সাজানো গোছানো ঘরোয়া হোটেলটি, চমৎকার পরিবেশ । সামনে বিস্তীর্ণ পাহাড় দেখা যাচ্ছে , শিরুই পাহাড় , বরফাবৃত নয় । রাজু বললো ” এই শিরুই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মাইলের পর মাইল জুড়ে ফুটে থাকে শিরুই লিলি ফুল ।

এই শিরুই লিলি বা শিরুই কাশুং তিম্রাওওয়ান একটি বিরল ভারতীয় প্রজাতির উদ্ভিদ যা পূর্বে মায়ানমারের সীমানা  থেকে পশ্চিমে শিরুই গ্রাম, দক্ষিণে চৈথর গ্রাম থেকে  উত্তরে সিহাই গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানের বিস্তীর্ণ  পাহাড়ের ঢালে ফুটে থাকে । তখন এখান থেকেও পাহাড়টি রঙ্গীন লাগে । ফ্যাকাশে নীল-গোলাপী পাপড়ির এই লিলি ফুল ফোঁটার সেরা মরসুম ১৫ ই মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত। স্থানীয় বিশ্বাস যে একজন রাজকন্যা তার প্রেমিক শিরুইয়ের সাথে পাহাড়ে বাস করতেন এবং তার মৃত্যুর পরেও সে তার জন্য অপেক্ষা করতেন এবং যে মাটিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয় সেই মাটি থেকে প্রতিবছর ফুল আসে । আর একটি কিংবদন্তি হ’ল লিলি নামে দেবী ফিলাভার এক কন্যা এই পাহাড়গুলিকে সুরক্ষা দেয়। তৃতীয় আরেকটি গল্পে  কথিত আছে যে অনেক কাল আগে এক প্রেমিক যুগল মারা গিয়েছিলেন শিরুই চূড়া থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের প্রেমের সাক্ষী হিসেবে এই লিলি ফুল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আলো করে রাখে ” ।

মন্ত্রমুগ্ধের মতন রাজুর মুখে গল্পগুলি শুনছিলাম আর ভাবছিলাম কিভাবে এক এক জায়গার বিশেষ দ্রষ্টব্যস্থান কে ঘিরে নানা কিংবদন্তী আর উপকথা আবর্তিত হয় । ঐতিহ্যগতভাবে এই শিরুই লিলি দয়া, সুরক্ষা, সমৃদ্ধি এবং একটি সুখী জীবন উপস্থাপন করে বলে বিশ্বাস করা হয় । বেলা প্রায় পড়ে এসেছিলো । আকাশে পেঁজা তুলোর মতন মেঘ অস্তমিত সূর্যের লাল আভায় রাঙা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল । এক ঝাঁক পাখী মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল । বোধহয় যার যার বাড়ী ফিরবে বলে । আমরাও এই ভালো লাগার রেশ টা স্মৃতির গভীরে জমিয়ে রেখে ঘরে ঢোকার জন্যে উদ্যোগ নিলাম রাজু কে রাতের মতন বিদায় জানিয়ে ।

যেকোনো ভ্রমণের এই এক একটা মুহূর্ত টুকরো টুকরো কোলাজের মতন বহু বছর এমনকি সারাজীবনই হয়ত থেকে যায় স্মৃতির গভীরে । মাঝে মাঝেই পুরোনো অ্যালবাম ঘাঁটার মতন সেই ভ্রমণ স্মৃতির পাতা ওল্টাতে বেশ লাগে । দোতলায় রুমে এসে দেখি ছোট্ট সাজানো গোছানো ঘর , অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে খাট । একপাশে টিভি আর বসার সোফা । মেঝে পুরো কাঠের । দেওয়ালের পর্দা সরাতেই দেখি দেওয়াল জোড়া কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে গোধূলিকালের শিরুই পাহাড় ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের অপরূপ দৃশ্য । পুরোপুরি অন্ধকার না হওয়া অব্দি সেই দৃশ্য চেটেপুটে উপভোগ  করলাম আর তারপর একটু পরেই গরম ধোঁয়া ওঠা চিকেন কারি আর ভাত সহযোগে তৃপ্তির ডিনার সারা হল । রাত যত বাড়ছিল ঠান্ডাও তত জম্পেশ হয়ে পড়ছিল । কম্বল মুড়ি দিয়ে সারাদিনের একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ জুড়িয়ে এলো আমাদের  টেরই পাইনি ।

ভোরবেলা মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙলো । তড়িঘড়ি ক্যামেরা নিয়ে বাইরে ব্যালকনি তে এসে দেখি আকাশ রাঙা করে সূর্যদেব শিরুই পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে । চোখে দেখা সেই দৃশ্যের গভীরতা আর ব্যাপ্তি কখনোই ক্যামেরায় ধরা যায়না জানি তাও কিছু মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করে তারপর ঝটপট স্নানপর্ব সেরে ব্রেকফাস্ট সারা হল ।

হোটেল থেকে চেক আউট করে চললাম ব্ল্যাক পটারি বা কালো মৃৎশিল্পের জন্যে খ্যাত নুঙবি গ্রামে । উখরুল থেকে আনুমানিক ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে যে জাতীয় সড়কটি ইমফল থেকে জেসামি হয়ে কোহিমা র দিকে গেছে সেই রাস্তার ধারেই তাংখুল নাগা অধ্যুষিত এই গ্রাম । যাবার পথেই পড়বে শিরুই গ্রাম । এই শিরুই গ্রামেই প্রতিবছর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শিরুই লিলি উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ।

গাড়ীতে উঠে আধঘণ্টার মধ্যেই চলে এলাম শিরুই গ্রাম এ । একদম নিরালা নিরিবিলি জায়গা , কয়েকজন স্থানীয় মানুষজন ছাড়া বাইরের পর্যটক প্রায় নেই বললেই চলে ।

Way to Shirui peak
শিরুই গ্রাম

এই গ্রাম থেকেই ট্রেক করে শিরুই জাতীয় উদ্যানে যাওয়া যায় যা শিরুই লিলির জন্যে বিখ্যাত । শুনলাম শিরুই লিলি ফেস্টিভ্যালের সময়ে এখানে বেশ ভীড় হয় । জাপানি পর্যটকদের ভালোই সমাগম হয় তখন । কিন্তু এখন কেউ নেই । পাহাড়ের ঢাল ও এখন ন্যাড়া । বুঝলাম ওই নির্দিষ্ট কয়েক সপ্তাহে নীলাভ লিলির সৌন্দর্যে না সেজে ওঠা অব্দি এই জাতীয় উদ্দ্যান ও তৎসংলগ্ন এই গ্রামের কোন কদর নেই । আমাদের কিন্তু শান্ত প্রকৃতির এই নিরাভরণ রূপ টাই ভারী ভালো লাগল , যদিও অসময়ে আসার দরুন শিরুই লিলির দর্শন হলনা ।

এরপর আবার এ বাঁক সে বাঁক পেরিয়ে আরো ঘন্টাখানেকের মধ্যে চলে এলাম ব্ল্যাক পটারির জন্যে বিখ্যাত নুঙবি গ্রাম এ । জাতীয় সড়কের থেকে বাঁয়ে একটা মোড় ঘুরে খানিকটা উৎরাই এ নেমে এলো আমাদের স্করপিও আর তারপর বড় একটা সমতল জায়গায় গাড়ী দাঁড় করালো ইরফান । গাড়ী থেকে নেমে রাজুর সাথে চলে এলাম নুঙবি গ্রামের খ্যাতনামা এক মৃৎশিল্পীর বাড়ী ।

প্রথমেই বাড়ীর উঠোন । মহিলারা ঘরকন্নার কাজ করছেন । বাচ্চারা খেলছে । বয়স্ক এক ভদ্রলোকের সাথে রাজু এরপর আলাপ করিয়ে দিলেন , ইনিই শিল্পীর বাবা । হিন্দি বা ইংরিজি ভালো না জানা তাংখুল নাগা আদিবাসী এই ভদ্রলোক ব্যবহারের আন্তরিকতায় মুহূর্তে আপন করে নিলেন আমাদের । ভিতরের অন্দরমহলে যেতে বললেন উনি যেখানে ওনার বিখ্যাত পুত্রের শিল্পকর্ম শোভা পাচ্ছে ।

Black Pottery Nungbi Village (2)
নুংবি গ্রামে ব্ল্যাক পটারি

ছোট একটা পনিটেল বাঁধা দোহারা চেহারার এক যুবক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ওনার ষ্টুডিও টা ঘুরে দেখালেন । বুঝলাম ইনিই সেই জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত শিল্পী ।

দেওয়ালের এক কোণে বেশ কিছু সার্টিফিকেট শোভা পাচ্ছে দেখলাম আর আলমারির তাকে সাজানো নিটোল কালো পটারির নমুনা । থালা, বাটি , গেলাস থেকে শুরু করে ফুলদানি মায় হামান দিস্তা পর্যন্ত । শুনলাম এক বিশেষ ধরণের কালো পাথর যা কিনা এই নুঙবি গ্রামেই পাওয়া যায় তার গুঁড়োর সাথে বিশেষ এক প্রকারের মাটি মিশিয়ে এই জিনিষগুলি বানানো হয় । তারপর ভারতের বিভিন্ন বড় শহরের শোরুমে এমনকি বিদেশেও এগুলি রপ্তানি হয় । বহু শতাব্দী আগে যখন স্টিল বা এলুমিনিয়ামের প্রচলন ছিলনা তখন এই ব্ল্যাক পটারির হাঁড়ি কড়াইতেই রান্নার প্রচলন ছিল। । এখনো স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস করে যে এই কালো কড়াইয়ে রান্না করা মাংস অতীব সুস্বাদু হয় ।

টুকিটাকি কিছু কালো মৃৎশিল্পের নমুনা সংগ্রহ করে ওনার পরিবার কে বিদায় জানিয়ে নুঙবি গ্রাম টা ঘুরে দেখলাম আমরা । বাঁশ , বেত আর টিনের চালের বেশ কিছু বাড়ী – বাড়ীর সামনে উঠোন । প্রায় সব বাড়ীর ভেতরে বা সামনের উঠোনে কালো মৃৎশিল্পের কাজ চলছে । কিছু বাড়ীর সামনে দেখলাম বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষের আয়োজন । ভারী সুন্দর একটা অনুভূতি নিয়ে  এখানকার গ্রাম্য জীবন ও কালো মৃৎশিল্প  সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে এবারে ফিরে চললাম ইম্ফলের পথে ।

উখ্রুল ভ্রমনের ছবিগুলি দেখতে এখানে ক্লিক করুন

আবার উখরুল এসে ফিরতি পথে বিকেল বিকেল ইমফালের পোলো হোটেলে ফিরে এলাম । ৩১ শে ডিসেম্বরের রাত টা অনাড়ম্বর ভাবেই পোলো হোটেলে মাছ ভাত খেয়েই কাটলো । সত্যি কথা বলতে কি নিউ ইয়ার ইভে কলকাতায় যেভাবে হৈ হুল্লোড় করে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা হয়  তার কানাকড়িও  ইম্ফলের এই অঞ্চলে আমাদের অন্ততঃ চোখে পড়েনি । যাই হোক এতদিনের বেড়ানোর ধকলে ক্লান্তও ছিলাম আমরা । এক ঘুমে সকাল । পরেরদিন নতুন বছরের প্রথম দিন রাজু আর ইরফানকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ফিরতি বিমানপথে কলকাতায় ফেরা । সাথে নিয়ে এলাম একরাশ অভিজ্ঞতা আর সুখস্মৃতি ।

(মণিপুর ভ্রমণকাহিনী সমাপ্ত)

https://www.agoda.com/shalom-lodge/hotel/kohima-in.html?cid=1844104

https://ukhrul.nic.in/tourism/ https://www.facebook.com/25DegreeNorthHotelUkhrul/

প্রয়োজনীয় লিংকগুলি

2 Comments

  1. সুপ্রিয় ভৌমিক

    খুব ভালো লাগলো। লেখাটি অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। এই ভ্রমণ কাহিনী অজানা মনিপুর কে একদম খোলা পাতার মত সামনে এনে দিল। লেখক এবং চিত্রগ্রাহক কে অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর ভাবে তুলে ধরার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *