স্থানঃ বুলগেরিয়ার সোফিয়া, রিলা, বানস্কো, প্লভদিভ, কাজানলুক ও ভেলিকো টারনোভো
সময়- মে-জুন, ২০১৭ যাত্রীগণ – মনিদীপা দাশগুপ্ত ও দেবাশিস দাশগুপ্ত
লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত
অন্তিম পর্ব
এই সিরিজের শেষ পর্বটি বুলগেরিয়ার গোলাপ উৎসব সম্পর্কে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মুখ্যতঃ এখানে আসা। কিন্তু এর সঙ্গে উপরি পাওনা হল বুলগেরিয়াকে কাছের থেকে জানা – তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য , সুপ্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। বলকান পর্বতমালার ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত বুলগেরিয়ার কাজানলুক অঞ্চলের রোজ ভ্যালিতে প্রতিবছর জুনের প্রথম সপ্তাহান্তে গোলাপ উৎসব হয়।
১১৮ বছর আগে প্রথম এই গোলাপ উৎসবের সূচনা হয়। গোলাপ ফোটার মরশুমে প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হয়ে থাকে। প্রধানতঃ এই অনুষ্ঠানটির আকর্ষণেই আমরা বুলগেরিয়ায় উপস্থিত হলাম মে’ মাসের শেষে। বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় তিন দিন কাটিয়ে গেলাম স্কি রিসোর্ট বানসকোতে । সেখান থেকে ট্রেনে চেপে বুলগেরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর প্লভদিভ হয়ে আমাদের কাজানলুকে যাবার পরিকল্পনা, যেখানে অনুষ্ঠিত হবে গোলাপ উৎসব। এই গোলাপ উৎসব প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বুলগেরিয়া ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন দেশ, এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের আগেও এর ইতিহাস আছে। সপ্তম শতাব্দীতে বুলগেরিয়া প্রজাতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথের সংযোগ স্থলে অবস্থিত – একটি পূর্ব ও উত্তর ইউরোপ থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এবং অন্যটি মধ্য এবং পশ্চিম ইউরোপ থেকে মধ্য প্রাচ্য পর্যন্ত। গ্রীস, রোম এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের লোকজন ব্যবসায়ের পণ্য নিয়ে বুলগেরিয়ায় আসত। ১৩৯৬ সালে পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীর জন্য এটি অটোম্যান শাসনের অধীনে এসেছিল। অটোম্যান তুর্কিরা অভিজাত সম্প্রদায়কে নির্মূল করে বাকী বুলগেরীয়দের ওপর প্রভুত্ব স্থাপন করেছিল। পশ্চিম ইউরোপের নবজাগরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বুলগেরিয়ার জনগণ তাদের মুক্তির সংগ্রামকে নতুন জাতীয় চেতনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ১৮৭৬ সালের এপ্রিলে গণঅভ্যুত্থানে সামিল হয়ে । ৩০,০০০ বুলগেরিয়ানদের গণহত্যার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে ১৮৭৬ সালে বৃহৎ শক্তি গোষ্ঠী কনস্টান্টিনোপল সম্মেলনের আয়োজন করে যার সিদ্ধান্তে অটোম্যানরা সম্মত হয় না। তার ফলে রাশিয়া ১৮৭৭-৭৮ সালে তুরস্কের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বুলগেরিয়ানদের সহায়তায় অটোম্যানদের পরাজিত করে তৃতীয় বুলগেরিয়ান সাম্রাজ্য গঠন করে। প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে বৈরী মনোভাব উভয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বুলগেরিয়াকে জার্মানির পক্ষে থাকার ব্যাপারে প্ররোচিত করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বুলগেরিয়া অনেক আঞ্চলিক ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির সাথে জোটবদ্ধ হয়েও ইহুদি জনগোষ্ঠীকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে প্রেরণ করতে অস্বীকার করেছিল এবং তাদের রক্ষা করেছিল।তারা মিত্রশক্তির সাথে শান্তি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং জার্মান বাহিনীকে বহিষ্কার করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলস্বরূপ বুলগেরিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল এবং পূর্ব ব্লকের একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮০-৯০ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলির পতনের মধ্য দিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় এবং বাজার ভিত্তিক অর্থনীতির উপর নির্ভর করে বুলগেরিয়ায় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়।বর্তমানে বুলগেরিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কাউন্সিল অফ ইউরোপ এবং ন্যাটোর সদস্য। বুলগেরিয়া ইউরোপের একমাত্র দেশ, যার নাম দেশটির আসল প্রতিষ্ঠার পর থেকে একবারও পরিবর্তিত হয়নি। এতো গেলো বুলগেরিয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
আমরা এখন বুলগেরিয়ার রাজধানী শহর সোফিয়ায় এসেছি। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রাল, রাশিয়ান চার্চ, সেন্ট সোফিয়া চার্চ, জাতীয় ঐতিহাসিক মিউজিয়াম ইত্যাদি। আলেকজান্ডার নেভস্কি অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল তার অনন্য স্থাপত্য, অভ্যন্তরীন সৌন্দর্য এবং সোনার গম্বুজগুলি দ্বারা সকল পর্যটককে মুগ্ধ করে রেখেছে। এটি একটি বুলগেরিয়ান ঐতিহ্য মন্ডিত ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন।
রুশ-তুর্কি যুদ্ধের সময় ১৮৭৭-৭৮ সালে বুলগেরিয়ার স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে মারা যাওয়া ২,০০,০০০ রাশিয়ান সৈন্যের স্মরণে ১৮৮২ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে তৈরী এই বিশাল, বিস্ময়কর গীর্জাটি কেবল সোফিয়ার নয়, সমগ্র বুলগেরিয়ার প্রতীকগুলির মধ্যে একটি। । এটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর রাশিয়ান যোদ্ধা-যুবরাজের স্মরণে নামাঙ্কিত করা হয়েছে।রাশিয়ান স্থপতি আলেকজান্ডার পোমেরান্টেসেভ দ্বারা নির্মিত, এই গির্জাটি নব্য-বাইজেন্টাইন রীতিতে নির্মিত হয়েছিল । এটি মোজাইক এবং সোনার পাতে মোড়া গম্বুজ দ্বারা সুসজ্জিত। এর অভ্যন্তরভাগ বর্তমানে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মুরালগুলি, সুদৃশ্য ঝাড়বাতি এবং অ্যানিক্স এবং আলাবাস্টার পাথরে তৈরি সিংহাসন দ্বারা সুসজ্জিত।
অটোম্যান সাম্রাজ্য থেকে রাশিয়ার দ্বারা বুলগেরিয়া স্বাধীন হওয়ার পরে ১৮৮২ সালে ধ্বংস হয়েছিল সারা মসজিদ আর সেই জায়গায় ১৯০৭- ১৯১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল রাশিয়ান চার্চ । এটি রাশিয়ান দূতাবাসের সরকারী গির্জা হিসাবে নির্মিত হয়েছিল, যা আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রালের কাছেই অবস্থিত। সোফিয়ায় রাশিয়ান সম্প্রদায়ের জন্য তৈরি হওয়ার কারণে এটি রাশিয়ান গির্জা হিসাবে পরিচিত। গির্জার নকশাটি রাশিয়ান স্থপতি মিখাইল প্রেওব্রাজেনস্কি সপ্তদশ শতাব্দীর মস্কোর রাশিয়ান পুনর্জীবন স্থাপত্যশৈলী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেছিলেন। নির্মাণটি তত্ত্বাবধান করেছিলেন স্থপতি স্মিরনভ, যিনি নিকটেই আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রালও তৈরি করেছিলেন। ভেতরের মুরালগুলি ভাসিলি পারমিনভের নেতৃত্বে শিল্পীদের একটি দল দ্বারা আঁকা হয়েছিল, যারা আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রালের চিত্রগুলিও আঁকেন। পাঁচটি গম্বুজই সোনার পাতে মোড়া। ঘন্টাটি দ্বিতীয় রাশিয়ান সম্রাট নিকোলাস দান করেছিলেন।
সেন্ট সোফিয়া গীর্জাটি চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীতে এটি ছিল রোমান থিয়েটারের অবস্থান। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে আরও কয়েকটি গীর্জা এখানে নির্মিত হয়েছিল যেগুলি গোথ এবং হুনের মতো আক্রমণকারী বাহিনীরা পরে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বর্তমানের বেসিলিকার মূল অংশটি এই স্থানের উপরে নির্মিত পঞ্চম কাঠামো বলে মনে করা হয় এবং এটি বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান প্রথমের রাজত্বকালে ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এটি কনস্টান্টিনোপলের সুপরিচিত হাগিয়া সোফিয়া গির্জার সমসাময়িক । দ্বিতীয় বুলগেরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজত্ব কালে (দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দী ) এটি মহানগরীর গীর্জার মর্যাদা অর্জন করে। চৌদ্দ শতকে গির্জাটির নাম অনুসারে শহরের নামকরন হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে, অটোম্যান শাসনের সময় গির্জাটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছিল, দ্বাদশ শতাব্দীর আঁকা মূল ফ্রেসকো গুলি ধ্বংস করা হয়েছিল এবং নতুন মিনারগুলি তৈরি করা হয়েছিল। উনিশ শতকে দুটি ভূমিকম্পের ফলে একটি মিনার ধ্বংস হয়ে যায় এবং মসজিদটি পরিত্যক্ত হয়। ১৯০০ সালের পরে এর সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল। সেন্ট সোফিয়া চার্চ এখন দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের প্রাচীন খ্রিস্টান স্থাপত্যের অন্যতম মূল্যবান নিদর্শন।
পরপর এতোগুলি চার্চ দেখে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট নেদেলিয়া স্কোয়ারে হোলি সোফিয়ার স্ট্যাচু দেখতে গেলাম। ফেরার সময় প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের সামনে দেখলাম জনতার ভীড়। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটু বাদে দেখলাম প্যারেড করতে করতে কয়েকজন রক্ষী এলো এবং তাদের মধ্যে দুজন পুরনো রক্ষীদের সঙ্গে স্থান বদল করলো। তারা আগামী এক ঘন্টা এখানে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকবে। তবে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে এই রক্ষী বদল ব্যাপারটা যেরকম লন্ডনের বাকিংহ্যাম প্রাসাদে অথবা মস্কোয় লেনিনের মুসোলেয়ামে দেখেছিলাম এখানে সেটা অতটা ইম্প্রেসিভ বা চিত্তাকর্ষক লাগলোনা।
সোফিয়া শহরের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে জাতীয় ঐতিহাসিক যাদুঘর যা পূর্ব ইউরোপের বৃহত্তম সংগ্রহশালাগুলির মধ্যে অন্যতম এবং এখানে ৬,৫০,০০০ এরও বেশি নিদর্শন রয়েছে। সংগ্রহের সর্বাধিক মূল্যবান বস্তুগুলির মধ্যে প্রাচীন থ্রেসিয়ান কোষাগার, পুরানো অস্ত্রশস্ত্র এবং মধ্যযুগীয় গির্জার প্লেটগুলি অন্তর্ভুক্ত।থ্র্যাসিয়ানরা হ’ল ইন্দো-ইউরোপীয় উপজাতির একটি দল যা আধুনিক বুলগেরিয়ার চারদিকে মধ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি বৃহৎ অঞ্চলে বাস করত। থ্রেসিয়ানদের হয় নিজস্ব দক্ষ কারিগর ছিল অথবা গ্রীক কারিগরদের সঙ্গে তাদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তারা সুন্দর করে অলংকৃত স্বর্ণ এবং রৌপ্য বস্তু যেমন বিভিন্ন ধরণের মুদ্রা, পাত্র, মুখোশ, গহনা, অস্ত্র, বর্ম ইত্যাদি তৈরি করত যা পার্শ্ববর্তী দেশ গুলি বিশেষ করে গ্রীকদের সংস্কৃতি দ্বারা ভীষণ ভাবে প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। শত্রু আক্রমণ এবং অরাজকতার সময় তারা এগুলি মূল্যবান জিনিসপত্রের সঙ্গে মাটীতে পুঁতে রাখত। আজ অবধি, থ্র্যাসিয়ান সভ্যতার প্রধান ধারক দেশ বুলগেরিয়ায় ৮০ টিরও বেশি স্থানে থ্র্যাসিয়ান ধনসম্পদ খনন করে পাওয়া গিয়েছে।
পরদিন আমরা গেলাম শহরের অদূরে সেন্ট নিকোলাস এবং সেন্ট প্যানটেলিমন চার্চ যা বয়ানা চার্চ নামে পরিচিত সেটি দেখতে। এই গির্জাটি মধ্যযুগীয় ফ্রেস্কোর জন্য বিখ্যাত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই বয়ানা চার্চ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এর ৯০টি মুরাল বুলগেরীয় মধ্যযুগীয় শিল্পকর্মের উৎকর্ষতার উদাহরণ। বয়ানা চার্চের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি তৈরির ধাপ লক্ষ্য করা যায়। দশম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে একটি ছোট ক্রস-গম্বুজযুক্ত চার্চ নির্মিত হয়েছিল, যা পুরনো গির্জা হিসাবে পরিচিত। এটি দ্বাদশ শতাব্দীতে সংস্কার করা হয়েছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, পুরনো গির্জার পশ্চিমদিকের সম্মুখভাগে উপরের তলে একটি ছোট চ্যাপেল যুক্ত হয়েছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সেন্ট নিকোলাস এবং সেন্ট প্যানটেলিমনকে উৎসর্গীকৃত একটি দ্বিতল সংলগ্ন ঘর নির্মিত হয়েছিল। বয়ানা চার্চ ১৯৫৪ সাল অবধি কার্যক্ষম ছিল।বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এর সংস্কারের কাজ শুরু হয় যা ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলেছিল। সেন্ট নিকোলাসের জীবন ১৮টি কম্পোজিশনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে যা উত্তর দিকে অবস্থিত এবং সম্ভবত এটি একটি সমাধি চ্যাপেল। এখানে রিলা মনাস্টেরির বুলগেরিয়ান সেন্ট ইভানের চিত্রও পরিলক্ষিত হয়। সেন্ট পান্টেলিমনের চ্যাপেলের দ্বিতীয় তলায় ফ্রেসকোগুলি একই সময়কালীন তবে শৈলীতে পৃথক। যিশু খৃষ্টের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা যেমন ঘোষনা, ক্রুশবিদ্ধকরণ, পুনরুত্থান এবং সেন্ট পান্টেলিমনের জীবনের বিভিন্ন টুকরো ঘটনা এখানে বিধৃত হয়েছে।
সোফিয়া শহরকে বিদায় জানিয়ে এবারে আমরা চললাম রিলা মনাস্টেরির উদ্দেশ্যে। সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে, ঘন জঙ্গল আর কুলুকুলু বয়ে চলা নদীকে পাশে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। এই মনাস্টেরিটি বুলগেরিয়ার রাজধানী – সোফিয়া থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে রিলা পর্বতমালার কোলে অবস্থিত।এটি দশম শতাব্দীর প্রথমার্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রিলার সেন্ট জন বুলগেরিয়ান জনগণের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সাধু, মঠের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং একজন ধর্মীয় শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন। রিলা অঞ্চলে একটি গুহায় তিনি অনেক কাল কাটিয়ে ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি অনেক লোককে সুস্থ করেছেন এবং অলৌকিক কাজকর্ম সংঘটিত করেছেন। কথিত আছে যে জার পিটার তাঁর সাথে দেখা করতে এবং তাকে পুরস্কৃত করার জন্য অনেক দূর থেকে এসেছিলেন। তবে রিলার সেন্ট জন সেই উপহারগুলি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁর সাথে দেখা করতে রাজি হননি। ৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর ৩৪ বছর পর তিনি বুলগেরিয়ান অর্থোডক্স চার্চ দ্বারা সেন্টহুডে বৃত হয়েছিলেন। ১০৯৫ সালে জার আসেনের আদেশে তাঁর দেহাবশেষ ভেলিকো টারনোভোতে স্থানান্তরিত করা হয়। তিন শতাব্দী ধরে সেখানকার একটি গির্জায় রাখার পর ১৪৬৯ সালে দ্বিতীয় সুলতান মোহাম্মদের নির্দেশ অনুযায়ী সেই দেহাবশেষ রিলা মঠে ফিরিয়ে আনা হয়।
১৩৩৩ সালে এখানে একটি প্রতিরক্ষামূলক টাওয়ার তৈরি হয়েছিলো যা আজ অবধি রয়ে গেছে এবং এটি মধ্যযুগীয় রিলা মঠটির এক আশ্চর্য নিদর্শন।২৫ মিটার উঁচু টাওয়ারটিতে ৫ তলা রয়েছে এবং উপরের তলায় একটি চ্যাপেলটি রয়েছে “ক্রাইস্টের রূপান্তর” যা পুরোপুরি ফ্রেস্কো দিয়ে সজ্জিত এবং চৌদ্দ শতক থেকে আজ অবধি টিকে আছে । মধ্যযুগীয় মঠটির সবচেয়ে মূল্যবান শিল্পকর্মটি রাফায়েলের ক্রস।উৎকর্ষতার দিক থেকে রিলা মঠটি ইউরোপের বৃহত্তম মঠগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী। রিলা পর্বতমালার পটভূমিকায় স্থাপিত রিলা মঠটি শুধু সৌন্দর্যে অতুলনীয় নয় এটি বিশেষ আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ একটি স্থান। স্থাপত্যটিতে কালো এবং সাদা তোরণ, কাঠের সিঁড়ি এবং বিশাল লোহার গেট এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। বহু রঙের টাইলগুলি দ্বারা মেঝে রঙ করা এবং অসাধারণ পেইন্টিংগুলি দ্বারা দেয়ালগুলি সজ্জিত। এই রিলা মনাস্টেরি বুলগেরিয়ান জাতীয় পুনর্জীবন স্থাপত্যশৈলী দ্বারা অনুপ্রাণিত এক অনবদ্য সৃষ্টি। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় এর অন্তর্ভুক্তি বুলগেরিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এই মঠটিকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
রিলা মনাস্টেরি দেখে এবারে আমরা চললাম বানসকোর উদ্দেশ্যে। দক্ষিণ বুলগেরিয়ার বানসকো শহরটি পিরিন পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত স্কি-য়ের স্বর্গরাজ্য হিসাবে খ্যাত। । পিরিন পর্বতমালার সর্বোচ্চ শিখরটি প্রায় ২৯০০ মিটার উঁচু। শহরের মধ্য দিয়ে একটি ছোট নদী বয়ে চলেছে।ভ্রমনপিপাসুদের জন্য এটি এক প্রিয় গন্তব্যস্থল।বানসকো থেকে আব্রামভ আমরা যাব ন্যারোগেজ ট্রেন ধরে। সেখান থেকে প্লভদিভ যাব গাড়ীতে। বানসকো শহর ছাড়াবার একটু পরেই ট্রেন লাইনের পাশে অসাধারণ সব দৃশ্য দেখলাম। বরফ ঢাকা পিরিন পর্বতমালা আর ছোট ছোট গ্রাম । যাত্রীরা স্থানীয় বুলগেরিয়ান, আমাদের মতন দুয়েকজন পর্যটক এবং কিছু জিপসি যাত্রী যাদের এরা ‘রোমা’ বলে।ট্রেনের কামরাগুলি মোটামুটি আরামদায়ক। কিছুক্ষণ পরে অপর দিকের জানলা দিয়ে দেখলাম ছোট খরস্রোতা নদী বইছে- পাশে সবুজ উপত্যকা – কোথাও তার মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আরো কিছূটা চলার পরে আমাদের গন্তব্য স্থল আসার আগে পথটা বেশ চড়াই মনে হল। আর দুপাশে পাইন, ফার আর ওক গাছের গভীর জঙ্গল । তার একটু পরে ট্রেনটা সিগন্যাল পোস্টের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা মাঝারি মাপের স্টেশন – ওখানেই আমাদের নামতে হবে। আমাদের দোভাষী ও গাইড মেয়েটি আমাদের বানসকো স্টেশনে ছেড়ে দিয়েছিল – এখন দেখলাম আব্রামভ স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। ট্রেন থেকে নেমে এবার গাড়ীতে চললাম প্লভদিভের উদ্দেশ্যে – অনেক ছোট ছোট গ্রাম ও শহর পেরিয়ে অবশেষে উপস্থিত হলাম আমাদের গন্তব্যস্থলে।
দক্ষিণ বুলগেরিয়ায় অবস্থিত প্লভদিভ প্রাচীন থ্রেসিয়ান অধ্যুষিত উন্নত সভ্যতার ওদ্রিসিয়ান রাজ্যের অংশ ছিল এবং অনেক রাজত্বের ওঠা পড়ার সাক্ষী। ইউরোপের প্রাচীনতম বিভিন্ন রাজশক্তি দ্বারা বিভিন্ন সময়ে ক্রমাগত অধিকৃত শহরটি দেখতে ভ্রমনার্থীদের ভিড় সব সময়ে লেগে থাকে। শহরটি সাতটি পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছিল এবং এর আশেপাশের অঞ্চলটি বলকান এবং রোডোপ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত । থ্রেসিয়ানদের পরে বল্কান পর্বতমালা থেকে এজিয়ান সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল রোমানরা দখল করে নেয়। নবম শতাব্দীতে এই অঞ্চল পারসিকদের দ্বারা বুলগেরিয়ার মধ্যে অধিগৃহীত হয়। চতুর্দশ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর সময়কালে এই প্লভদিভ অঞ্চল অটোম্যান সামাজ্যের একেবারে মধ্যভাগে অবস্থিত ছিল।১৮৭৮ সালে স্বাধীনতার পর বার্লিন চুক্তি অনুযায়ী প্লভদিভ রুমেলিয়া প্রদেশের অন্তর্গত হয় যা পরে সংযুক্তিকরনের মাধ্যমে বুলগেরিয়ার সাথে যুক্ত হয়।বুলগেরিয়ার জনগণ পুরনো প্লভদিভ শহরের প্রাচীন ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এখনো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।এখানে খনন করে অনেক প্রাচীন সভ্যতার ধংসাবশেষ ও স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ১৮০ মিটার লম্বা অশ্বক্ষুরাকৃতি ৩০০০০ আসন বিশিষ্ট রোমান স্টেডিয়ামের সন্ধানও এখানে পাওয়া গেছে – যার খনন এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।। এখানে প্রাচীন রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারেরও খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। দশ বছরের বেশী সময় লেগেছিলো এটি খুঁড়ে বার করতে। দুটি তলে বিভক্ত প্রায় ৭০০০ আসন বিশিষ্ট অ্যাম্ফিথিয়েটারটি তৎকালীন স্থাপত্য ও সৌন্দর্যের বিরল নিদর্শন।
প্লভদিভ দেখার পরদিন একেবারে সকাল বেলায় আমরা চললাম কাজানলুকের উদ্দেশ্যে যেখানে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে গোলাপ উৎসব। এই উৎসবের প্রধান তিনটি আকর্ষণ – প্রত্যূষে গোলাপ বাগান থেকে ফুল তোলা, গোলাপ রাণীর নির্বাচন ও এই উপলক্ষে রাস্তায় অনুষ্ঠিত প্যারেড যা দেখতে সারা বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটক এখানে উপস্থিত হয়। সকালে শহরের সমস্ত অতিথি আশেপাশের গোলাপের ক্ষেতগুলি পরিদর্শন করেন যেখানে তারা গোলাপ সংগ্রহ করেন, ফটো তোলেন এবং লোকনৃত্যের পরিবেশনা উপভোগ করেন। শুক্রবার এবং শনিবার সন্ধ্যায় কাজানলুকের মূল স্কোয়ারে লোকসঙ্গীতের কনসার্ট এবং প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সমস্ত অংশগ্রহণকারীরা বুলগেরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে।
বুলগেরিয়ান রোজ ভ্যালিটি দেশের সর্বাধিক উর্বর অঞ্চলে অবস্থিত। কাজানলুক, কার্লোভো, পাভেল বানিয়া এবং স্ট্রেলচা শহরগুলির চারদিকে গোলাপের চাষ হয়। তাছাড়া এখানকার বিখ্যাত গোলাপ ফুল বুলগেরিয়ান গোলাপ তেল উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে এক কেজি তেল উৎপাদনের জন্য প্রায় তিন টন গোলাপের প্রয়োজন হয়। ‘রোজা দামেসেনা’ তেল উৎপাদনকারী গোলাপের নাম, যা বুলগেরিয়াকে বিশ্বের সেরা গোলাপ তেল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত করেছে। সিরিয়ার দামাস্কাসে জন্ম হলেও ‘রোজা দামেসেনা’ সপ্তদশ শতাব্দীতে বুলগেরিয়ান ভূখণ্ডে আনা হয়েছিল, যখন বুলগেরিয়া অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এই সুগন্ধযুক্ত গোলাপটি বুলগেরিয়াকে তার দ্বিতীয় আবাসস্থল হিসেবে গ্রহণ করেছিল।যার ফলে এই পুরো অঞ্চলের নাম হয়েছে বুলগেরিয়ার ‘গোলাপ উপত্যকা’। বলকান পর্বতশ্রেণী অঞ্চলে ১৩০ কিলোমিটারেরও বেশি প্রসারিত গোলাপ উপত্যকাটি দুটি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত, যা শীতের সময় ঠান্ডা বাতাস থামিয়ে দিয়ে গোলাপ উৎপাদনের জন্য সুনির্দিষ্ট জলবায়ু তৈরিতে সহায়তা করে এই অঞ্চলটিকে এই ধরণের গোলাপ চাষের জন্য বিখ্যাত করে দিয়েছে। এখান থেকে প্রস্তুত তেল বিশ্বের সেরা মানের। তাই এই গোলাপ উপত্যকা বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে গোলাপ থেকে তৈরি তেল উৎপাদন এবং রপ্তানীর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
এই উৎসব শুরু হয়েছিল ১১৮ বছর আগে, ১৯০৩ সালে। এই উৎসবের উৎযাপন গোলাপ ফুল, তার সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্যকে সম্মান জানানোর জন্য এক প্রয়াস যা সমগ্র গোলাপ উপত্যকা জুড়ে এক বাৎসরিক উৎসবের সূচনা করে থাকে প্রতি বছর। ছুটির দিনটির সকাল বেলা প্রাচীন প্রথা ও আচার অনুযায়ী গোলাপ সংগ্রহের আনন্দ সকলের সঙ্গে স্থানীয় মানুষজন ভাগ করে নেয়। প্রতি বছর একটি সুন্দরী মেয়েকে মুকুট পরিয়ে গোলাপ সুন্দরী হিসাবে নির্বাচন করা হয় এবং তিন দিনের গোলাপ উৎসব উদযাপনের সূচনা হয়। গোলাপের সুগন্ধ সবচেয়ে শক্তিশালী হয় খুব সকালে। গোলাপ ফুল তোলার অনুষ্ঠানটি রীতি মতো চিত্তাকর্ষক উৎসব। বুলগেরিয়ান মেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিতা হয়ে বাগান থেকে সংগৃহীত ফুলের ঝুড়ি বহন করে নিয়ে আসে। তদুপরি কয়েকটি ঝুড়ি গোলাপের সুগন্ধযুক্ত পাপড়ি দিয়ে পূর্ণ করা হয় যার থেকে নৃত্য গীত অনুষ্ঠান চলাকালীন ফুলের পাপড়ি অতিথি অভ্যাগত সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পর শুরু হয় শহরের রাস্তায় কাজানলুক স্ট্রিট কার্নিভাল যা বুলগেরিয়ার বৃহত্তম স্ট্রিট কার্নিভাল।এই অঞ্চলের স্কুলগুলি, কিন্ডারগার্টেন, সংগঠন এবং ক্লাবগুলির বিভিন্ন সদস্য রাস্তায় তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য মন্ডিত পোশাক পরে প্রধান রাস্তার প্যারেডে সম্মিলিত হয়। রাস্তার দুপাশে ফুলের পাপড়ি আর গোলাপের সুগন্ধি সুবাস ছড়িয়ে দেওয়া হয় উপস্থিত জনতার মধ্যে।
গোলাপ বুলগেরিয়ার অন্যতম প্রতীক। তাই বিশ্বের একমাত্র ‘রোজ মিউজিয়াম’ যেখানে গোলাপ ফুলের নির্যাস থেকে তেল উৎপাদনের প্রতিটি পর্ব সবিস্তারে প্রদর্শিত হচ্ছে তা যে কাজানলুক শহরে অবস্থিত হবে তাতে আর আশ্চর্য কি?। রোজ মিউজিয়ামটি রোজারিয়াম পার্কের একটি নতুন ভবনে অবস্থিত। জাদুঘরটি কাজানলুকের ঐতিহাসিক যাদুঘর “ইস্করা” এর একটি অংশ। ১৯৬৭ সালে একটি ছোট্ট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, যা কাজানলুক এবং এই অঞ্চলের গোলাপ উৎপাদন ও বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত ছিল। ১৯৬৯ সালে প্রদর্শনীটি একটি স্বাধীন যাদুঘরের রূপ নেয় । যাদুঘরের প্রদর্শনীতে গোলাপ উৎপাদন ও বিকাশের মূল চিত্র এবং নথি, গোলাপ উদ্যানগুলির প্রক্রিয়াজাতকরণের সরঞ্জাম, গোলাপ তেল সংরক্ষণ ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক কিছু প্রদর্শিত হয়েছে।১৯১২ সালে তৈরি গোলাপ তেলের পরীক্ষার জন্য প্রথম পরীক্ষাগারটি যাদুঘরে তৈরি করা হয়। যাদুঘরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হ’ল গোলাপ তেলের পাত্র যা সর্বশেষ ১৯৪৭ সালে ব্যবহৃত হয়েছিল এবং আজও এর চারপাশে গোলাপের সুগন্ধ পাওয়া যায়। যাদুঘরের অভ্যন্তরে পর্যটকদের জন্য একটি সুন্দর দোকান রয়েছে যেখানে কেউ চাইলে তথ্য সামগ্রী, স্যুভেনির, প্রসাধনী, গোলাপ ইত্যাদি কিনতে পারে। ১৭৪০ সালে একটি ফরাসি সংস্থা বুলগেরিয়া থেকে গোলাপ তেল প্রথম রফতানি করে। সেই সময় থেকেই বুলগেরীয় গোলাপ তেল ফ্রেঞ্চ সুগন্ধি উপাদকদের কাছে পছন্দসই কাঁচামাল হিসেবে গন্য হত।
পরের দিন সকাল বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম ভেলিকো টারনোভোর উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুটা গাড়ীতে যাবার পর আমরা এলাম শিপকা পাস । শিপকা পাস বা গিরিপথ মধ্য-বলকান পাহাড়ের উপরে ৬৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত যা ১৮৭৭-৭৮ সালে রাশিয়া-তুরস্ক যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করছে। রাশিয়ান এবং বুলগেরিয়ান যৌথ বাহিনীর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ১৯৩৪ সালে এখানে একটি ওয়ার মেমোরিয়াল বা যুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপনা করা হয়। এই স্মৃতি স্তম্ভ পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত যেখান থেকে চারিদিকের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রায় ১০০০ সিঁড়ি ভেঙ্গে আমরা উঠলাম সেখানে। সেই সময়কার ব্যবহৃত কিছু কামান রাখা আছে সেখানে ।
এখান থেকে ভেলিকো টারনোভো শহরের দূরত্ব প্রায় ৫০ মাইল। মধ্য বুলগেরিয়ার এই ছোট শহরটিতে পাহাড়ের মাথায় আছে ত্সারেভেৎস যা দুর্গের বাড়ি হিসাবে সুপরিচিত। যেহেতু, এটি একসময় জার বা সম্রাটদের আবাস স্থল ছিল, শহরটিকে ‘জারের শহর’ বলা হত। দুর্গটি ৩০০০ ফুট লম্বা পাথরের দেয়াল দ্বারা ঘেরা। প্রাচীরের অনেকগুলি অঞ্চল থেকে আশেপাশের মনোরম পাহাড়ের ৩৬০ ডিগ্রি জুড়ে দৃশ্যপট এবং নীচে মনোমুগ্ধকর শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। শহরের পুরানো অংশটি পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছিল তাই এখানে ঘোরানো পাথরের বাঁধানো রাস্তা, ঐতিহ্যবাহী বাড়ি এবং প্রাচীন গীর্জার উপস্থিতি চোখে পড়ে। ‘ক্লোজ-বাই’ হ’ল একটি পবিত্র ও বিখ্যাত মঠ, যা প্রত্নতাত্ত্বিকতার সঙ্গে শিল্পবৈশিষ্ট্যযুক্ত স্থাপত্যের সুন্দর সংমিশ্রণ।
ভেলিকো টারনোভো শহর দেখার মধ্য দিয়ে আমাদের বুলগেরিয়া সফরও শেষ হলো। এরপর রুসে শহরের উপর দিয়ে দানিউব নদী পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করবো রুমানিয়ায়। রুসে শহরের একটা পেট্রল পাম্পে আমরা আমাদের পরবর্তী সারথী এবং গাইডের জন্য অপেক্ষায় রইলাম । এতদিন ধরে যে মেয়েটি বুলগেরিয়ার সব দর্শনীয় স্থানগুলি হাসি মুখে অনেক আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের ঘুরিয়ে দেখালো তাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থল বুখারেস্টের উদ্দেশ্যে।
Leave a Reply