সময়– এপ্রিল ২০১৮ যাত্রীগণ – দেবাশিস দাশগুপ্ত ও মনিদীপা দাশগুপ্ত
লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত
স্থান – বরোবুদুর ও প্রাম্বানান
This is a travelogue in Bengali about Bororbudur and Prambanan, the two World Heritage Sites representing the rich cultural heritage of Java (erstwhile Jabadwip), Indonesia.
বিমান থেকে দেখা যায় নীচে অনেক ছোট ছোট দ্বীপ যেগুলিকে ঘিরে আছে ভারত মহাসাগরের নীল জল। তার রঙ কোথাও ঘন নীল কোথাও বা নীল আর সবুজের সংমিশ্রণ। বিমান এবার ধীরে ধীরে নীচে নামছে। আমাদের অবতরণস্থল যোগজাকার্তার আদিসুতজীপ্ত বিমানবন্দর। স্থানীয় লোকেরা যোগজাকার্তাকে সংক্ষেপে বলে যোগজা। যোগজাকার্তা যবদ্বীপ বা জাভার প্রধান প্রদেশগুলির মধ্যে অন্যতম।ইন্দোনেশিয়ার অসংখ্য দ্বীপ গুলির মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল দ্বীপ হচ্ছে জাভা যার নাম ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। প্রাচীন কাল থেকেই যোগজাকার্তা ইন্দোনেশিয়ার সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবং সেই ঐতিহ্য এখনও চলে আসছে। এখানকার দুটো বিখ্যাত জায়গা বরোবুদুর এবং প্রাম্বানন উভয়ই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা লাভ করেছে।
বিমান বন্দরে নেমে বাইরে এসে দেখলাম প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড সদা হাস্যময় উইডোডো। আমাদের হাতে কম সময় থাকায় আমরা বিমান বন্দর থেকে সোজা রওয়ানা দিলাম রয়্যাল প্যালেস বা সুলতানের রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে। রাজপ্রাসাদের চত্বরে একটা নাট্মন্দিরের মত জায়গা যেখান বাদ্য যন্ত্র সহযোগে গামেলানের বাজনার একঘেয়ে আওয়াজ ভেসে আসছে। গামেলান ইন্দোনেশিয়ার বহুল প্রচলিত এক বাজনা। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা গেলাম সংলগ্ন মিউজিয়ামটি দেখতে। এখানে ইন্দোনেশিয়া এবং জাভার ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, স্থানীয় লোকেদের পোশাক পরিচ্ছদ ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কিত অনেক তথ্য সংরক্ষিত আছে। পাশে একটি বাটিক মিউজিয়ামও আছে যেখানে বাটিকের বিভিন্ন নমুনা গুলি প্রদর্শিত রয়েছে এবং কি ভাবে তা তৈরি হয় তা দেখানো হয়েছে। এখানে সুলতান এবং তাঁর পরিবারও বসবাস করেন। এই রাজপ্রাসাদটি হচ্ছে এখানকার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতীক।
একটানা যাতায়াতের ধকলে এবং সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে খিদেও পেয়েছিল। শহরের মধ্যে একটা রেস্তোরাঁয় আমরা দ্বিপ্রাহরিক লাঞ্চ সারলাম। এখানকার স্থানীয় খাবার যথেষ্ট সুস্বাদু। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থান প্রাম্বানান মন্দির। আমাদের গাইড উইডোডো বলল যে যাবার পথে সাম্বিসারি মন্দির পড়বে সেটাও আপনারা দেখে নিতে পারবেন। এই মন্দিরটি নবম শতাব্দীতে তৈরী এক প্রাচীন শিব মন্দির। মাউন্ট মেরাপি থেকে নির্গত ছাই চাপা পড়ে মন্দিরটি বহুদিন লোক চক্ষুর আড়ালে পড়ে ছিল। এর খনন এবং সংস্কার সম্পন্ন হয় ১৯৮৭ সালে। মন্দিরটি রাস্তার থেকে অনেকটা নীচে। মন্দিরের অভ্যন্তরে গিয়ে দেখলাম সেখানে একটি শিবলিঙ্গ আছে।
বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থান আমরা দেখতে পাই এই শহরে যা হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এক সময়ে এবং পরবর্তী কালে মুসলিম সুলতানের এবং ঔপনিবেশিক ডাচ বা ওলন্দাজ সরকারের অধীনে ছিল।এরমধ্যে অবশ্য ব্রিটিশ এবং ওলন্দাজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের পর বছর পাঁচেক (১৮১১ – ১৮১৬) এখানে ব্রিটিশ শাসন কায়েম ছিল। ১৯৪৫ সালে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। জাভা প্রাচীন কাল থেকে হিন্দু সভ্যতা এবং পরম্পরায় বিশ্বাসী ছিল আর তার প্রভাব এখানকার কৃষ্টি ও জনজীবনে পরিলক্ষিত হয়। রামায়নের কাহিনীতে আমরা পাই যে কিষ্কিন্ধার রাজা সুগ্রীব সীতার অপহরণের পর তাঁর খোঁজে তার লোকজনকে যবদ্বীপ অর্থাৎ এখনকার জাভায় পাঠিয়েছিল। হিন্দু বনিকরা তাদের বাণিজ্য তরী নিয়ে ব্যবসা সূত্রে যখন এখানে আসত তখন তারা সঙ্গে নিয়ে আসত ভারতের ধর্ম, কৃষ্টি ও চিন্তাধারা যা এখানকার জনমানসকে প্রভাবিত করেছিল। আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বিস্তার হয়েছিল মুলতঃ ভারত থেকে আগত বৌদ্ধ তীর্থ যাত্রী ও চৈনিক সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে।
এই দুটি ধর্মই পারস্পরিক সহবস্থানের মাধ্যমে এবং সেই সময়কার শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিলো। অষ্টম এবং নবম শতাব্দীতে এখানে অনেক মনগ্রাহী বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির ও স্মারক তৈরি হয়েছিল যার নিদর্শন এখনও আমরা দেখতে পাই। শৈলেন্দ্র রাজারা এই সময়কালে বরোবুদুর স্তূপ তৈরি করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীতে সঞ্জয় বংশীয় রাজারা প্রাম্বানান হিন্দু মন্দিরগুলি তৈরি করেছিলেন যা পরবর্তী রাজাদের সময় আরও বিস্তার লাভ করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে প্রবল ভূমিকম্পের ফলে এই মন্দির গুলি বিশেষ করে প্রাম্বাননের মন্দির গুলি বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূকম্পন প্রবণ এলাকায় অবস্থানের কারণে এই ঝুঁকি এখানে সব সময়েই থাকে।অতি সাম্প্রতিক কালে ২০০৬ সালেও এই মন্দির গুলি ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতি গ্রস্ত হয়েছিল।
রবিঠাকুর তৎকালীন সুলতানের আমন্ত্রণে একবার যোগজাকার্তায় এসেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে লেখা ‘জাভা যাত্রীর পত্র’ থেকে কয়েকটা লাইন তুলে ধরছি। “ যোগ্যকর্তার প্রধান ব্যক্তি হচ্ছেন এখানকার সুলতান। তাঁর বাড়ীতে রাত্রে নাচ দেখবার নিমন্ত্রণ ছিল। সেখানে একজন ওলন্দাজ পণ্ডিতের কাছে শোনা গেল যে, এই জায়গাটির নাম ছিল অযোধ্যা; ক্রমে তারই অপভ্রংশ হয়ে এখন যোগ্যা নামে এসে ঠেকেছে। ………পথে আসতে পেরাম্বান বলে এক জায়গায় পুরোনো ভাঙ্গা মন্দির দেখতে নামলুম। এ জায়গাটা ভুবনেশ্বরের মত, মন্দিরের ভগ্নস্তূপে পরিকীর্ণ । ভাঙ্গা পাথর গুলি জোড়া দিয়ে দিয়ে ওলন্দাজ গবর্মেন্ট মন্দিরগুলিকে তার সাবেক মূর্তিতে গড়ে তুলছেন। কাজটা খুব কঠিন, অল্প অল্প করে এগোচ্ছে ; দুই-একজন বিচক্ষণ য়ুরোপীয় পণ্ডিত এই কাজে নিযুক্ত। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে বিশেষ আনন্দ পেলুম। “
প্রাম্বানানের ভগ্নস্তূপের মধ্যে থেকে যেকটি মন্দির এখনো অক্ষত আছে তার মধ্যে প্রধান তিনটি মন্দির হচ্ছে শিব, ব্রহ্মা ও বিষ্ণু মন্দির । শিব মন্দিরটি সবচেয়ে উঁচু -১৫৬ ফুট এবং বাকি দুটি মন্দির ১০৮ ফুট উঁচু। এই তিনটি মন্দিরের বিপরীতে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ছোটো তিনটি মন্দির – তাঁদের তিন বাহনের যথা নন্দী, হংস এবং গরুড়। রামায়নের কাহিনী এবং কৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা প্রধান মন্দির গুলির দেয়ালে খোদিত আছে। শিব মন্দিরের অনেক গুলি প্রকোষ্ঠ আছে – মধ্যে শিবের মূর্তি, উত্তরে দুর্গা, দক্ষিণে অগস্ত্য মুনি ও পশ্চিমে গণেশের মূর্তি ।
বিভিন্ন সময়ে ভুমিকম্প ও মাউন্ট মেরাপি থেকে উদ্গীরণের কারণে আনুমানিক দশম শতাব্দীতে রাজ্যপাট এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয় এবং প্রাম্বাননের এই সুন্দর মন্দিরগুলি সংস্কার এবং সংরক্ষণের অভাবে ক্রমে ক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়। এখন এখানে নিত্যপুজা অনুষ্ঠিত হয়না। শুধু বিশেষ কিছু উৎসবের দিনে পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। ভাবতে অবাক লাগে মূল ভারত ভুখন্ড থেকে এত দূরে স্থানীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল। এখনও টুরিস্টদের সঙ্গে সর্বধর্ম নির্বিশেষে স্থানীয় সাধারণ মানুষরাও এই পুরাতাত্বিক বিস্ময় গুলি উপভোগ করতে দলবেঁধে এখানে আসে। প্রাম্বানানের মন্দির গুলি দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। আর কিছক্ষণ বাদে শুরু হবে রামায়ন ব্যালে– যা দেখতে সারা পৃথিবী থেকে লোকে এখানে আসে। আমরা অডিটরিয়ামের কাছে পৌঁছে গেছি। অনতিদূরে দেখা যাচ্ছে তিনটি আলোকজ্বল মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে । ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর অর্থাৎ সৃষ্টি , স্থিতি ও প্রলয় যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ভরা তারার মাঝে।
যথা সময়ে রামায়ণ ব্যালে শুরু হল। ঘোষক রামায়ণ গল্পের সারাংশ সংক্ষেপে বর্ণনা করল যাতে বিদেশী দের বুঝতে সুবিধে হয়। আমরা সে অর্থে বিদেশী ছিলাম না। বরঞ্চ মনে হচ্ছিল স্বদেশের কোন রঙ্গমঞ্চে বসে এই নৃত্যনাট্য উপভোগ করছি। সত্যি কথা বলতে কি দেশের মাটিতে এত সুন্দর রামায়ণের উপর সৃষ্ট কোন নৃত্য নাট্য দেখেছি বলে তো মনে পড়েনা। গামেলান বাজনার আবহ সঙ্গীত ও কখনো জাভানীজ সঙ্গীতের মূর্ছনার মধ্যে শুধু অভিনয়ের মাধ্যমে রামায়ণের ঘটনাগুলি দর্শকদের সামনে উপস্থাপনা করা হয়েছে অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে। শুধু নৃত্য গীতই নয় আলোক সম্পাতের কাজও অসাধারণ। বিশেষ করে হনুমান দ্বারা লঙ্কা কাণ্ডের ঘটনা, সীতার অগ্নি পরীক্ষা ও পাতাল প্রবেশ অত্যন্ত নিপুনতার সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে। এই দু ঘন্টা আমরা মন্ত্র মুগ্ধের মত অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছি।এই রামায়ণ ব্যালে অনুষ্ঠানটি প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে প্রাম্বানান মন্দির প্রাঙ্গনে। এর একমাস বাদে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ইন্দোনেশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, যিনি এই সমগ্র অনুষ্ঠানটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। ব্যালে নাচ দেখে অভিভূত হয়ে ক্লান্ত শরীরে প্রায় রাত এগারোটায় আমরা মনোহরা রিসোর্টে পৌঁছলাম।
এই মনোহরা রিসোর্টটি বরোবুদুর স্তুপ থেকে হাঁটা দূরত্বে। এর ভেতরে পরিবেশটা খুবই সুন্দর। আসলে এটা একটা রিসারচ সেন্টার যেখানে বরোবুদুর ও বৌদ্ধধর্ম নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর ভেতর একটা সুন্দর অডিটোরিয়াম আছে। সেখানে বিভিন্ন ভাষাতে ভগবান বুদ্ধের জীবনী এবং বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দিক প্রাঞ্জল ভাষায় অডিওভিসুয়াল প্রতিবেদনের মাধ্যমে পরিবেষিত হয়। বিশেষ বিশেষ দিন গুলিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভক্ত ও সাধুরা এখানে সমবেত হন ধর্ম চর্চার উদ্দেশ্যে।
বরোবুদুর মহাযান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মন্দির। পরবর্তীকালে কোন এক অজ্ঞাত কারণে তা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় এবং সভ্য সমাজের চোখের আড়ালে বহুকাল অবহেলিত হয়ে ছিল। ব্রিটিশ শাসন কালে তদানীন্তন গভর্নর র্যাফেলস স্থানীয় লোকের মারফৎ জানতে পারেন যে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা উঁচু টিলা আছে যা দেখে মনেহয় যে তার নীচে কোনও প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক সৌধ আছে । দীর্ঘ দু বছরের প্রচেষ্টায় ১৮৮৫ সালে তা আবার সবার সামনে স্বমহিমায় ফিরে আসে। অতি সাম্প্রতিক কালে ২০১০ সালে আগ্নেয়গিরি মাউন্ট মেরাপির উদ্গীরণের ফলে বরোবুদুর স্তুপের উপরের অংশ সম্পূর্ণ রূপে ছাইয়ে ঢাকা পড়েযায় এবং তা পরিষ্কার করে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দিতে প্রায় বছর খানেক সময় লেগেছিল।
বরোবুদুর বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বৌদ্ধ স্তুপ। উচ্চতায় ১১৫ফুট, প্রায় ১০০ সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে হয়। নীচে থেকে উপরে যাবার কালে এর একেকটি তলে দেয়াল গাত্রে আমরা দেখতে পাই অসংখ্য প্রস্তর খোদিত মূর্তি যা কিনা সমসাময়িক সাধারন মানুষের জীবন যাত্রার এবং ভগবান বুদ্ধের জাতকের কাহিনীর প্রজ্জ্বল প্রতিফলন।পাখীর চোখ দিয়ে দেখলে দেখা যাবে এখানে চারটে চতুষ্কোণ স্তর আছে এবং তার উপরে তিনটি বৃত্তাকার স্তর।এই প্রত্যেকটি স্তরই ওপর দিকে ওঠার সাথে আয়তনে ক্রমশঃ সংকুচিত হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি বৃত্তাকার স্তরে অনেক গুলো ছোট ছোট স্তুপ আছে এবং সবার শীর্ষে আছে একটি বড় স্তুপ।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এখানে আসেন আত্মোপলব্ধির জন্য। সবচেয়ে নীচের স্তরটি জাগতিক কামনা বাসনার প্রতীক- এর নাম কামধাতু। তার উপরের স্তরটি কর্ম এবং তার ফলের প্রতীক – এর নাম কর্মধাতু। এই স্তর পেরিয়ে উপরে গেলে দেখা যাবে ভগবান বুদ্ধের জীবনের অনেক ঘটনা নিয়ে প্রস্তর দেওয়ালে উৎকীর্ণ বিভিন্ন মূর্তি। এই স্তরটির নাম রূপধাতু। আমাদের সবার মধ্যে জ্ঞান উন্মেষের যে সম্ভাবনা নিহিত আছে ভগবান বুদ্ধের জীবনের মধ্য দিয়ে তা রূপ লাভ করেছে। তার উপরে অবস্থিত মহাকালের দ্বার দিয়ে যাবার সময় উপলব্ধি হবে যে জগৎ বিশ্ব সবই হচ্ছে ক্ষণ স্থায়ী – শুধু কালের গর্ভে বিলীন হবার অপেক্ষায়। রূপ, রস গন্ধ সব কিছুর গন্ডী ছাড়িয়ে রূপ থেকে অরূপে উত্তরনের এই স্তরটি হচ্ছে অরূপধাতু। এরপরের স্তরে শুধু সারি সারি স্তুপ। ভক্তগণ পেছনে ফেলে এসেছেন কাম, কর্ম ও রূপ। এখানে এসে মায়া ও বিভ্রমের মোহ মুক্ত হয়ে নিমীলিত নয়নে তাঁরা মগ্ন হন ধ্যানে। সবচেয়ে উপরে শীর্ষের স্তুপটি হচ্ছে অন্তিম লক্ষ্য বা নির্বাণের প্রতীক।
পরের দিন আমরা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম স্তুপের উপর থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য। কিন্তু বাইরে তখন কুয়াশার স্তর ভেদ করে খুব বেশী দেখা যাচ্ছেনা। খানিকটা বিফলমনোরথ হয়ে ‘বুদ্ধং শরণম্ গচ্ছামি’ মন্ত্র সম্বল করে আমরা হেঁটে চললাম বরোবুদুরের উদ্দেশ্যে। উপরে উঠে যখন শীর্ষের স্তুপ গুলির কাছে পৌঁছলাম তখন কুয়াশার আস্তরন ভেদ করে সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছেছে। নীচের অজ্ঞানতা ও পার্থিব মোহমায়াজাল ছিন্ন করে উপরে উঠতে পারলে তবেই তো পাওয়া যাবে চিরআকাঙ্খিত জ্ঞানের আলোকের সন্ধান। এই মেটাফর বা রূপক এর মধ্য দিয়েই যেন বরোবুদুরের মর্মবাণী উপলব্ধি করলাম।
বরোবুদুর প্রসঙ্গে রবিঠাকুরের লেখা ‘জাভা যাত্রীর পত্র’ থেকে কয়েকটি পঙক্তি তুলে ধরছি – “পাথরে-খোদা জাতক মূর্তিগুলি আমার ভারী ভা্লো লাগল – প্রতিদিনের প্রাণলীলার অজস্র প্রতিরূপ, অথচ তার মধ্যে ইতর অশোভন বা অশ্লীল কিছুমাত্র নেই। অন্য মন্দিরে দেখেছি সব দেবদেবীর মূর্তি, রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনীও খোদাই হয়েছে। এই মন্দিরে দেখতে পাই সর্বজনকে – রাজা থেকে আরম্ভ করে ভিখারী পর্যন্ত।বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে জনসাধারণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রবল হয়ে প্রকাশ পেয়েছে ; এর মধ্যে শুদ্ধ মানুষের নয় , অন্য জীবেরও যথেষ্ট স্থান আছে।জাতক কাহিনীর মধ্যে খুব একটা মস্ত কথা আছে, তাতে বলেছে যুগ যুগ ধরে বুদ্ধ সর্বসাধারণের মধ্য দিয়েই ক্রমশ প্রকাশিত। প্রাণী জগতে নিত্যকাল ভালোমন্দর যে দ্বন্দ্ব চলেছে সেই দ্বন্দ্বের প্রবাহ ধরেই ধর্মের শ্রেষ্ঠ আদর্শ বুদ্ধের মধ্যে অভিব্যক্ত।“
যোগজাকার্তাকে আমাদের এবার বিদায় জানাবার পালা। আমাদের গন্তব্য ইন্দোনেশিয়ার আর একটি দ্বীপ বালি। বালি বলতেই মনে হয় সেখানকার সংস্কৃতি, হিন্দু মন্দির গুলি, স্থানীয় লোকেদের সুন্দর হস্তশিল্প, তাদের সৌন্দর্য্যবোধ এবং সর্বোপরি বালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য – যা দেখে মোহিত হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “ সাগর জলে সিনান করি সজল এলো চুলে বসিয়া ছিলে উপল উপকুলে …………।“ তাই গরুড়ের ডানায় ভর করে এবারে আমাদের যাত্রা শুরু হবে বালির দিকে।ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম ক্যারিয়ার গরুড় এয়ারলাইন্সের কাউন্টার এর দিকে আমরা ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ
কেন যাবেন
বোরোবুদুর এবং প্রাম্বানন মন্দির দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়া ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের সাংস্কৃতিক ও শিল্পকলার রাজধানী যোগজাকার্তার খুব কাছাকাছি এই দুটি মহান স্থাপত্যের অবস্থান। এটা অবিশ্বাস্য যে এই ধরনের সৌন্দর্যের দুটি মন্দির একে অপরের এত কাছাকাছি অবস্থিত। তাদের সান্নিধ্যের সহজ কারণটি হল এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম (বোরোবুদুর মন্দির) এবং হিন্দু ধর্মের (প্রম্বানন মন্দির) মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগীতা। এর ফলে এই স্থানে আসা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এই অঞ্চলে ইন্দোনেশিয়ার এক বড় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
কোন সময়ে যাবেন
এপ্রিল থেকে অক্টোবর যোগজাকার্তা ভ্রমনের প্রকৃষ্ট সময়।
কি ভাবে যাবেন
কোলকাতা থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে (সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স) যোগজাকার্তা পর্যন্ত বিমান ভাড়া আনুমানিক ২১,০০০/-(এক দিকে)
কোথায় থাকবেন
Manohara Centre of Borobudur Study, Kompleks Taman Wisata Candi, Borobudur. Jl. Badrawati. Magelang -56553, Indonesia.
আনুমানিক ভাড়া দিনপ্রতি ৭৫০০/- ব্রেকফাস্ট এবং বরোবুদুরের এন্ট্রি ফি সমেত। এছাড়া দিনপ্রতি ৫০০০/- র মধ্যেও ভালো হোটেল পাওয়া যায়।
অন্যান্য খরচ
রামায়ণ ব্যালের এন্ট্রি ফি মাথা পিছু ৪৫০০/-, প্রাম্বানান মন্দিরের এন্ট্রি ফি মাথা পিছু ৩০০০/- (গাইড ছাড়া)
Ak kathay asadharon.
Bhari pranibanto bibaran ar jogyo sangat still ar video photo’r.
Flight details gulo aro ektu bishade janar agroho thaklo
ধন্যবাদ দেবাঞ্জন বাবু ।
Thanks for this detailed and helpful post. It helped me a lot
Thanks a lot. Please do share if you like the story.
from
Debasis Dasgupta