স্থান – লাদাখ
সময়- আগস্ট, ২০১৬ যাত্রীগণ – ওয়ান্ডারভোগেল ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর সহযাত্রীগণ
লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত
লাদাখের এক প্রত্যন্ত প্রান্তে অবস্থিত এক ছোট্ট জনপদ তুরতুক। এখান থেকে পাকিস্থান সীমান্তের দূরত্ব মেরেকেটে ৮-১০ কিলোমিটার হবে। নিয়ন্ত্রণ রেখার এপারে এটাই শেষ ভারতীয় জনপদ।
অবশ্য আক্ষরিক অর্থে শেষ গ্রাম হচ্ছে থাং যা একেবারে নিয়ন্ত্রণ রেখা বা LOC-এর ওপরে অবস্থিত। সেখান থেকে দুই দিকের পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত ভারতীয় এবং পাকিস্থানী বাঙ্কার চোখে পড়ে। তবে এই নিয়ন্ত্রণ রেখা অঞ্চলে পৌঁছতে গেলে ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিশেষ অনুমতি লাগে। ১৯৭১ এর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি অনুযায়ী এই গ্রামগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এককথায় অসাধারন।
একদিকে হিমালয় অন্য দিকে কারাকোরাম পর্বতশ্রেণীর মধ্যে অবস্থিত এই উপত্যকা খুবই উর্বর – পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শায়ক নদী। এখান থেকে পাকঅধিকৃত কাশ্মীরের পাহাড়ের শৃঙ্গ গুলি দেখা যায়। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে K2 র চূড়াও দেখা যায়। সিয়াচেন গ্লেসিয়ার যাবার রাস্তাও এর ওপর দিয়ে গিয়েছে।
২০১০ সালে তুরতুক গ্রাম ভ্রমনপিপাসু দের জন্য খুলে দেওয়া হয়।এখানে একটি বহু প্রাচীন প্রাক্তন শাসকের বাসস্থান আছে। তুরতুক জনপদের দুটি অংশ – তুরতুকের নীচের দিকের অংশ ‘ইউল’ আর ওপর দিকের অংশ ‘ফারোল’। এই দুই অংশ একটি ব্রীজ দ্বারা যুক্ত যা শুধু মনুষ্য এবং জীব জন্তু চলাচলের উপযুক্ত।
নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে এক পাহাড়ী খরস্রোতা নদী যা শায়ক নদীতে গিয়ে মিশেছে।
কাজেই সব গাড়ী ঘোড়া ব্রীজের পাশের পারকিং লটে রেখে পায়ে হেঁটে সব কাজ সারতে হয়।এখানে গ্রামীণ পায়ে চলা পাথুরে পথ ধরে আশেপাশের বসতি, চাষের ক্ষেত দেখতে দেখতে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা।
মনে হবে সময় যেন এখানে থেমে আছে অতীতকে আঁকড়ে ধরে। এখানে প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস এবং মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৩০০০। এই ব্রীজের পাশেই একটা ছোটো খাবার দোকানও আছে যেখানে স্থানীয় বালতি খাবার এবং কাওয়া চা, ঠান্ডা পানীয় ইত্যাদি পাওয়া যায়।
আগে পাকিস্থান অধিকৃত কাশ্মীরের বালতিস্থান অঞ্চলে থাকার কারনে এটাই লাদাখের একমাত্র অঞ্চল যেখানকার মানুষ বালতি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষা শুধু মাত্র মৌখিক , এর কোন স্বীকৃত লিপি নেই। লাদাখের একমাত্র এই স্থানেই স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে বালতি সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।এখানকার অধিবাসীরা খুবই পরিশ্রমী , সহজ সরল এবং আলাপী। এরা সুফি ভাবধারায় বিশ্বাসী মুসলিম ধর্মবালম্বী – এদের মধ্যে ধর্মের কোন গোঁড়ামি নেই। কথায় কথায় জানতে পারলাম এই গ্রামের একমাত্র বৌদ্ধ মনাস্ট্রি এরাই দেখা শুনা করে। এইগ্রামে একটা অতি প্রাচীন মসজিদ আছে- আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর । মসজিদের ভেতরে ইসলাম ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধ এবং ইহূদী ধর্মের পবিত্র প্রতীক লক্ষ করা যায়। প্রতি বছর এখানকার গ্রামবাসীরা ২১শে মার্চ ধূমধামের সঙ্গে পার্শি নববর্ষ উৎসব ‘নভরোজ’ পালন করে। পূর্বে এখানে প্রাচীন তিব্বতি ধর্ম ‘বন’এর প্রচলন ছিল। তারপরে অষ্টম শতাব্দী থেকে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যা চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বলবৎ ছিল। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে এখানে ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে। প্রাচীন সিল্ক রুটের উপর এর অবস্থানের জন্য অনেক দেশী বিদেশী শাসক এবং সওদাগরের সমাগম হ’ত এই অঞ্চলে। এই গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলের ইতিহাস, কৃষ্টি আর খাদ্যাভাস এর আশে পাশের অঞ্চলের থেকে আলাদা। এদের চেহারার মধ্যে মধ্য এশিয়ার জন জাতির প্রভাব লক্ষণীয়। এই জনগোষ্ঠী মূলতঃ আর্য্য ও মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর সংমিশ্রণে সৃষ্ট । এক সময় এখানকার স্বাধীন রাজা ছিল এবং তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক এবং ইরানের সঙ্গে ব্যাবসা বানিজ্য চলত। তুরতুক নামটা এসেছে তুর্কী ভাষার শব্দ ‘দুগদুগ’ থেকে যার অর্থ ‘ পছন্দসই জায়গা’- পরে এই নামটা অপভ্রংশ হয়ে তুরতুক হয়ে যায়।
এরা প্রধানত চাষবাস করেই জীবিকা নির্বাহ করে- তবে অন্য জীবিকার লোকও এখানে বাস করে, যার জন্য এরা সম্পূর্ণ রূপে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী এবং এদের বাইরের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়না। এদের তৈরি হস্ত শিল্পের কাজ প্রশংসনীয় । এখানে প্রধানতঃ অরগ্যানিক প্রথায় গম, বার্লি ও বাকহুইট (buckwheat)এর চাষ হয় আর আছে ফলের বাগান যেখানে আপ্রিকট, আপেল, প্লাম, আখরোট, নাসপাতি আর আঙ্গুরের ফলন হয় – এই সবই মুলতঃ বিদেশে রপ্তানী হয়। তবে স্থানীয় খাবার বেশীর ভাগই বাকহুইট থেকে তৈরী হয়। যেমন এই বাকহুইটের ময়দা থেকে এরা ‘কিসির’ নামের একধরনের নোনতা কেক বানায়। ‘ৎসামিক’ নামক য়োগারট দিয়ে তৈরি রায়তার মত একধরনের উপাদান সহযোগে এই নোনতা কেক এদের খুব প্রিয়। বছরের বেশিরভাগ সময় প্রবল শীতের জন্য এরা বাইরের জগতের থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন থাকে। সেই জন্য গ্রীষ্মের সময় যখন বাইরের লোকে এখানে আসে তারা আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করে তাদের জন্য। এখানে ট্যুরিস্টদের জন্য কয়েকটি হোমস্টে এবং গেস্টহাউস আছে। এখানে ৮০০ থেকে ১০০০ বছরের পুরনো দু-একটা বাড়ী আছে- কিন্তু সেগুলি বসবাসের অযোগ্য । এখানে শীতকালে তাপমাত্রা -৩৫ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায় অনেকসময় আবার গ্রীষ্মকালে তা প্রায় ৩২-৩৩ ডিগ্রী পর্যন্ত উঠে আসে। এখানে কিছু গুদাম ঘর আছে মোটা পাথরের দেয়ালে তৈরী, যেখানে গ্রীষ্মকালে গুদাম জাত জিনিস ঠাণ্ডা থাকে এবং শীতকালে থাকে গরম। এদের কাছে জানা গেল যে এইসব গুদাম ঘরে প্রায় ২৫ বছরের পুরনো মাখনও সঞ্চিত আছে।
এদের সঙ্গে আলোচনায় আর একটা কথা উঠে এল যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে গ্রামবাসীদের খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। প্রতি পরিবার থেকে অন্তত একজনের কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। বেশীরভাগই মাল বাহকের কাজ করে এবং যা পারিশ্রমিক পায় তা যথেষ্টই ভালো এবং তাতে তাদের ভাল ভাবেই চলে যায় । এদের বক্তব্য অনুযায়ী গ্রামবাসী ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখানে একে অন্যের পরিপুরক। সেনাবাহিনী যেমন এদের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে এরাও তেমনি প্রয়োজনে জানকবুল করতেও রাজী। শীতের সময় যখন চারিদিক বরফে ঢাকা তখনও এরা চড়াই ভেঙ্গে ভারী মাল নিয়ে সেনা ছাউনিতে পোঁছে দিয়ে আসে। সেনা বাহিনী গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য এবং তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্বও নিয়েছে। সেনাবাহিনী মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপ এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের শিক্ষামূলক ভ্রমণের ব্যবস্থাপনাও করে থাকে। একটি মেয়ের সাথে আলাপ হল যে কাশ্মীরে মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী – এখন ছুটিতে বাড়ীতে এসেছে। আমরা কাশ্মীর উপত্যকায় সচরাচর যে চিত্রটা দেখি এখানে তার ব্যতিক্রমী চিত্রটা চোখে পড়ায় খুবই ভাল লাগলো।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যঃ
কেন যাবেন
লাদাখের এক প্রত্যন্ত প্রান্তে অবস্থিত পাকিস্থান সীমান্তবর্তী এই গ্রাম। নিয়ন্ত্রণ রেখার এপারে এটাই শেষ ভারতীয় জনপদ। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এককথায় অসাধারণ।
কোন সময়ে যাবেন
জুন থেকে আগস্ট প্রশস্ত সময়
কি ভাবে যাবেন
সড়ক পথে মানালি থেকে লে অথবা শ্রীনগর থেকে জোজিলা পাস, কারগিল হয়ে লে। বিমানে সরাসরি লেতেও আসা যায়। লে থেকে খারদুংলা পাস, নুব্রা ভ্যালি হয়ে তুরতুকের দূরত্ব প্রায় ২১০ কিলোমিটার। লে থেকে শেয়ার গাড়ীতে মাথা পিছু ভাড়া আনুমানিক ৭০০ টাকা। পুরো গাড়ীর ভাড়া আনুমানিক ৫০০০ টাকা। ফেরার পথে তুরতুক থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে ডিস্কিট পর্যন্ত বাসে গিয়ে সেখান থেকে লে পর্যন্ত শেয়ার গাড়ী পাওয়া যায় – আনুমানিক ভাড়া ৫০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
হোমস্টের মাথা পিছু আনুমানিক খরচ (থাকা খাওয়া সমেত) ৬০০-১০০০ টাকা।
পারমিট এবং জরুরী কাগজ পত্র
লে র ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র পাওয়া যাবে। তবে বর্তমানে ইনার লাইন পারমিটের প্রয়োজন নেই। শুধু অনুমতিপত্র দরকার যা অনলাইনেও পাওয়া যাবে।
Leave a Reply