সিমলিপাল ভ্রমণের পূর্ব কথা

লেখা- তীর্থ দাশগুপ্ত

জঙ্গল আমার অতি প্রিয় গন্তব্য । অরণ্য প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ স্পর্শ আমাকে ছোটবেলা থেকেই টানে । অনেকের ই টানে , আমার মতন যারা জঙ্গলবিলাসী ও জঙ্গলপ্রেমী । সুযোগ পেলেই তাই ইচ্ছা হয় দুদন্ড প্রকৃতির কোলে কাটিয়ে আসি । নগরজীবনের যাঁতাকলে , নানাবিধ স্ট্রেসের থেকে মুক্তির একটা অন্যতম পথ নিষ্কলুষ প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া । এই অরণ্য প্রীতি অনেকটাই এসেছে বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী বুদ্ধদেব গুহর অগণিত লেখা পড়ে । আমি যে ওনার একনিষ্ঠ ভক্ত এবং আমার মতন অগণিত পাঠক পাঠিকা ,তা এর আগে কয়েকটি লেখায় আমি আগেই বলেছি । শেষ জীবনে ওনার সাথে ফোনালাপ হয় । সেই নিয়মিত আলাপচারিতা করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে দ্বিতীয়বার ভর্তির কয়েকদিন আগে পর্যন্ত চলেছিল ।

মনে আছে একদম প্রথম ফোনেই দাদা বলেছিলেন সিমলিপাল যাবার কথা । দেশ বিদেশের সব অরণ্যের মধ্যে সিমলিপালের মোহিনী রূপের আকর্ষণ সব চেয়ে বেশী ছিল ওনার কাছে এটাও বলেছিলেন । ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যাবার সাহস হয়না বলাতে বলেছিলেন ” বেপাড়ার সুন্দরী মেয়ে কে চুমু খেয়ে এলে সেপাড়ার জোয়ানেরা কি ঠ্যাঙাবে নাকি মালা দেবে ? “
সিমলিপাল হল ভয়ঙ্কর সুন্দরী । এর পর ওনার ই লেখা “অন্য চোখে ” বইতে ” ভয়ঙ্কর সুন্দরী “লেখা পড়ে আরো ধারণা হয় । আস্তে আস্তে খোঁজ নিয়ে দেখি যে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ওখানে এখন অনেকটাই কমেছে । তাই সাহসে ভর করে এই বছরের বর্ষশেষে আমার ও আমার বাল্য বন্ধুর পরিবার চারদিনের সিমলিপাল অরণ্য ভ্রমণের পরিকল্পনা করলাম ।

এই লেখাটি সেই ভ্রমণের পূর্ব কথা ।


জঙ্গল ভ্রমণ ঠিক আর পাঁচটা টুরের মতন নয় ।
1) ফরেস্ট বাংলো তে থাকতে হয় যেখানে সবরকম স্বাচ্ছন্দ্য নেই হোটেলের মতন। বিদ্যুৎ নেই । তাই সন্ধ্যের পর অন্ধকারে বিশেষ কিছু করার থাকেনা . তবে ফরেস্ট বাংলোর ব্যালকনি তে বসে রাতের জঙ্গলের শোভা অনুভব করতে বেশ লাগে । চুপ করে বসে থাকলে কতরকম আওয়াজ শোনা যায় । নানান গন্ধ নাকে আসে । সব মিলিয়ে এই আদিম পরিবেশ যাদের ভালো লাগে, অরণ্য ভ্রমণ তাদের টানবেই এটা বলতে পারি ।
2) সাজগোজের বাহুল্য অরণ্য ভ্রমণে চলেনা । লাল বা উত্তেজক কোনো রঙের পোশাক পরা চলেনা । কারণ জীবজন্তুরা উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে ।সবুজ , মেটে রং বা কোনো হালকা রঙের পোশাক চলে যাতে প্রকৃতির সাথে বেশ মানিয়ে যায় ।
3) বেশী উত্তেজক সেন্ট বা পারফিউম মাখা যায়না । এমন ও শুনেছি খুব কড়া পারফিউম গায়ে মাখাতে মৌমাছিরা ঘিরে ধরে এবং তাদের বিষদংশনে আহত হন কেউ কেউ ।
4) সেলফির পেছনে না ছুটে যতটা সম্ভব প্রকৃতির অনবদ্য শোভা ক্যামেরাবন্দি করতে হয় , বেশিটাই মনের ক্যামেরায় ।
5) পঞ্চয়ন্দ্রিয় কে খুব তীক্ষ্ণ করে চোখ , কান , , নাক সবের অনুভূতি নিয়ে সম্পুর্ন ভালো লাগায় কটাদিন কাটিয়ে আসতে হয় ।
6) নিজেদের মধ্যে বেশী কথা বলতে হয়না । তাতে প্রকৃতি র কথা শোনা যায়না । মানুষের কথাতেই সব চাপা পরে যায় । শহর জীবনে তো শুধুই শব্দ , বেশিটাই অনাবশ্যক । অরণ্য ভ্রমণে যাওয়া তো আসলে নিশব্দতার বাঙময়তা অনুভব করতে ।

তা যারা আমার বক্তব্যের সাথে একমত তাঁরাই পারবেন সম্পুর্ন প্রকৃতিকে অনুধাবন করতে ।
আমাদের কর্তব্য পরবর্তী প্রজন্ম কে মাঝে মাঝেই এই প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত হতে শেখানো ।

সিমলিপাল একসময়ে ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজার hunting ground । দেশ স্বাধীন হওয়ার জাতীয় উদ্যান হয় । দেখা মেলে প্রচুর হাতি , মাউস ডিয়ার , সম্বর , গাউর, স্পটেড ডিয়ার , সজারু , ময়ূর , নানাবিধ পাখী যেমন রাকেট টেইল্ড drongo ইত্যাদি । নামেই টাইগার রিজার্ভ কিন্তু বাঘ কেউ দেখতে পায়না । বিভিন্ন এক্সটিক প্ল্যান্টের সমাহার শুনেছি এই জঙ্গলে । গাইডের থেকে সব চেনার ইচ্ছা রইলো । রয়েছে শাল , আম , জাম , সাহাজ, শিশু , বেল , বিজা বা পিয়াশাল , তেঁতুল । এছাড়া নানারকম লতা , গিলিরি , পুটুস ঝোপ ইত্যাদি। গাছ শুধুই গাছ নয় । তার ও নাম আছে, সৌন্দর্য আছে । এক এক ঋতুতে তার এক এক রকম শোভা আছে ।


বিভিন্ন রকম প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায় । ইচ্ছা রইল সেইগুলা দেখে মুগ্ধ হওয়ার ।
আর আছে প্রচুর ঝর্ণা ও জলপ্রপাত । নামগুলিও ভারী সুন্দর , যেমন জোরান্ডা , বরেহিপানি, উস্কি ইত্যাদি । এই জলপ্রপাত ও সংলগ্ন জঙ্গলের শোভা কিছুটা পায়ে হেঁটেই ঘুরব আমরা । সিমলিপালে পর্যটকরা পায়ে হেঁটে ঘুরতে পারেন , যা এর আগে করবেট ফরেস্টে পারিনি আমরা । জোরান্ডা নামের উৎস ও খুব ইন্টারেস্টিং । কথাটা এসেছে জাউ রান্ধা থেকে । জাউ মানে জিউ । অর্থাৎ অনেক আগে জগন্নাথ দেবের ভোগ মানে অন্ন এখানেই কাছে কোনো গ্রামে নাকি রান্না হত । জোরান্ডা ফরেস্ট বাংলোয় রাতে থাকলে জলপ্রপাতের দিকে নাকি বিচিত্র সব আলো দেখা যায় জ্বলতে নিভতে । শহুরে পরিবেশে এসব অতটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও সভ্যতা থেকে দূরে ওই পরিবেশে এই সব ক্রিয়াকলাপ মনের উপরে যথেষ্ট অভিঘাত ফেলে ।


বরেহিপানি জলপ্রপাতের দৃশ্য নাকি অতুলনীয় । বুড়িবালাম নদী এখন থেকেই নাকি উৎপন্ন হয়েছে ।
আরো সুন্দর সুন্দর জায়গার নাম শুনলাম , যেমন নুয়ানা আর চাহালা । নুয়ানা মানে ন আনা । ময়ূরভঞ্জের রাজা কে ন আনা ট্যাক্স দিতে হত সেই আমলে এখানকার অধিবাসীদের । আবার চাহালা মানে নাকি টলি গেলা । সেই আমলে একবার বিদেশী অতিথি দের নিয়ে রাজা এই চাহালার জঙ্গলে আসেন ও কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনার সাক্ষী হন । অতিথিদের মধ্যে কারুর প্রাণহানিও হয় । চাহালা বাংলোর সামনে একটি বড় পিয়াশাল গাছ আছে । সেটি নাকি কুরুল দিয়ে যেই কাটতে যায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় । এই সমস্ত নানা গল্প এখানে প্রচলিত আছে । লোকালয় থেকে বহু ভিতরে , আদিম বিদ্যুৎ হীন পরিবেশে , রাতের নিঝুম পরিবেশে বাংলোর হাতায় বসে এই সমস্ত গল্প স্থানীয় মানুষজন বা আমাদের গাইডের ( তিনিও স্থানীয় ) মুখে শুনতে বেশ লাগবে আশাকরি ।


স্থানীয় মানুষজন বা আদিবাসীদের বাদ দিয়ে কোনো অরণ্য প্রকৃতিই সম্পূর্ণতা পায়না । ওঁরাও , মুন্ডা ইত্যাদি আদিবাসীদের বাস জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় । এছাড়া আছে বাথুরি সমাজ । এখানকার আদি অধিবাসী । পুজো করে তারা বরামদেও বা জঙ্গলের দেবতার । যেমন সুন্দরবনে দক্ষিণরায় বা বনবিবি । এদের গ্রাম , লোকাচার , গ্জীবনযাত্রা ,ইত্যাদি চাক্ষুষ করার ইচ্ছা রইল । প্রকৃত ভারতবাসী তো এরাই । এতদিন দাদার মানে শ্রী বুদ্ধদেব গুহর লেখা পড়ে মনে মনে এই অপরূপ প্রকৃতির যে ছবি এঁকেছি তা চাক্ষুষ করার সুযোগ হবে এটা ভেবেই আমার উত্তেজনার শেষ নেই । আমার ভ্রমণ সাথীরাও যথেষ্ট excited আশা করি ।


বাকি ভ্রমণ কথা বেড়িয়ে এসেই পরিবেশন করব ।

1 Comment

  1. Debanjan

    Simlipal, Aranyer dinratri, thaka-beranor anupunkho, Buddhadeb Guha’r anushango….. sab miliye, ak kathay chamatkar. Ei porbo’ta bhari manograhi laglo, nayanabhiram aranya’er barnonar mato

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *