মোহময়ী সিমলিপাল                        

লেখা ও ছবি – তীর্থ দাশগুপ্ত                

This travelogue in Bengali is based on tour to Simlipal tiger reserve , in Mayurbhanj district of Odisha. I tried to capture the majestic beauty of the forest along with few essential information in this travelogue.

   ” আচ্ছা , একদম গহীন জঙ্গলের ভিতরে বেশ ছোটখাটো একটা নির্জন বনবাংলোয়ে কদিন কাটালে কেমন হয় ? লোকালয় থেকে দূরে । নিরিবিলি পরিবেশে , পাখীর ডাক শুনতে শুনতে ঘুমোবে বা রাতে বাংলোর বারান্দায় বসে জ্যোৎস্নায়ে ভেসে যাওয়া জঙ্গলের শোভা দেখবে । আরো দারুন হয় বিছানায় শুয়ে শুয়েই পাশেই গড়িয়ে পরা জলপ্রপাতের দৃশ্য যদি দেখা যায় । দুপুরে বাংলোর বারান্দায় বসে নরম রোদের ওম পোহাবে । “
পুজোটা কাটলেই স্ত্রী ঋতুকে একদিন এরকম ভ্রমণ পরিকল্পনার কথা বলি ।

” বাঃ , দারুন কাব্যিক পরিবেশ তো । তোমার তো আবার জঙ্গল না হলে বেড়ানো হয়না । তা এরকম পরিবেশ পাবে কোথায় শুনি ? “
” পাবো পাবো, ভেবে রেখেছি । তুমি তো জানোই দাদা ( বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী বুদ্ধদেব গুহ ) প্রথম ফোনেই আমাকে সিমলিপাল যেতে অনুপ্রানিত করেন । প্রথম জীবনে ছিলেন শিকারী । দেশ বিদেশের নানান বন জঙ্গলের মধ্যে সিমলিপালের মোহময়ী রূপের আকর্ষণ ছিল অন্যতম ওনার কাছে।  । আমি ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করতে বলেছিলেন সিমলিপালের সৌন্দর্য্য অতুলনীয় । বেপাড়ার কোনো সুন্দরী মেয়ে কে চুমু খেয়ে এলে সেপাড়ার  জোয়ান ছেলে কি ঠ্যাঙাবে নাকি মালা দেবে , বল ? “
” খুব হেসেছিলাম সেই কথা শুনে “
তারপর অনেক খোঁজখবর নিয়ে দেখি ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অনেকটাই কমেছে ওখানে ।
শেষ পর্যন্ত আমি , স্ত্রী ঋতু আর আমার আট বছরের কন্যা ঠিক করি বড়দিনের ছুটিতে ২৬ শে ডিসেম্বর থেকে ৩০ শে ডিসেম্বর সিমলিপালেই যাবো । এরপর শুরু হল বিস্তর নেট ঘাঁটাঘাঁটি ।
  সিমলিপাল হল উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ জেলার টাইগার রিজার্ভ ।     প্রায় সাতাশশো বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত । অনেক এক্সটিক উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের সমাহার এই অরণ্যে – প্রাণীর ও । ঠিক করলাম জঙ্গলে গিয়ে জঙ্গলের ভেতরে থাকব । কিন্তু থাকব কোথায় ? উড়িষ্যার ইকো ট্যুরিজমের বুকিংয়ের ব্যবস্থা বেশ ভালো । এদের ফরেস্ট বাংলোগুলি অরণ্যের নিভৃতে ভারী সুন্দর লোকেশনে । বেশ কিছু জায়গায় বাংলো আছে , যেমন বাহেরিপানি , গুরগুড়িয়া , কুমারি , জানুযানি । অরণ্যের প্রবেশপথ দুই জায়গা দিয়ে । বারিপাদা দিয়ে , পিথাভাটা গেট পেরিয়ে অথবা যোশিপুর দিয়ে । অনেকেই পিথাভাটা গেট হয়ে ঢুকেছেন । কেউ কেউ আবার যোশিপুর হয়ে ঢুকেছেন । কি করব , কিভাবে এই ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজাব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নেটেই খুঁজে পাই শ্রী আব্দুল ওয়াহিদ কে । বেশ ভালো গাইড । ওনার সাথে ফোনেই আলাপ হল ।

আমাদের গাইড শ্রী আব্দুল ওয়াহিদ

উনি পরামর্শ দিলেন বালাসোর , বারিপাদা হয়ে না আসতে । অনেকটা পথ সাদামাটা জঙ্গল পথেই কেটে যাবে যেকোন ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছতে । বরঞ্চ জামশেদপুর হয়ে এলে সিমলিপাল মূল অরণ্যে দ্রুত প্রবেশ করা যাবে । ট্রেনে হাওড়া থেকে জামশেদপুর । সেখান থেকে    ১১০ কিলোমিটার দূরে ২২০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে হলদীপখার , তিড়িং , বাহালদা , রাইরাংপুর ইত্যাদি জায়গা পেরিয়ে যোশিপুর । যোশিপুর সদর থেকে ৩ কিমি দূরে বনদপ্তর , সিমলিপালের নর্থ কোর ডিভিশনের সদর দপ্তর । অরণ্য ভ্রমণের পারমিট ওখানেই হয় , যদিনা আপনি অনলাইনে অরণ্যের নিভৃতে চারটি ইকটুরিজম কটেজের কোনো একটি বুক না করেন । ইকটুরিজম কটেজে থাকলে থাকা খাওয়ার খরচের সাথে ফরেস্ট পারমিট , সাথে যে গাড়ীতে ঘুরবেন তার পারমিট ধরাই থাকে । যারা যোশিপুরে থেকে দিনে দিনে জঙ্গল বেরিয়ে আসতে চান তাদের যোশিপুরে বনদপ্তর থেকে পারমিট করতে হবে । যোশিপুর থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে সুন্দর লালমাটির জঙ্গলপথে পাবেন  কালিকাপ্রসাদ চেকগেট । সেখান থেকে অপূর্ব বনপথ , শালের জঙ্গল , পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে  বয়ে চলা খৈরি নদী পেরিয়ে নয় কিলোমিটার দূরে এসে পাবেন গুরগুড়িয়া গ্রাম । একেবারে সাউথ কোর ডিভিশনের কোর এরিয়ার গায়ে অবস্থিত । রবিবার সেই গুড়গুড়িয়া গাঁয়ে হাট বসে । লাল ধুলো ওঠা পথের ধারে নানাবিধ পসরা সাজিয়ে বসে গ্রামের দোকানীরা -ভালো লাগবে । এই গুড়গুড়িয়া গ্রামেই শান্ত বয়ে চলা খৈরি নদীর ধারে রয়েছে বনদপ্তরের ইকটুরিজম নেচার ক্যাম্প । তিনরাত সেখানেই ছিলাম । সেই গল্পে পরে আসছি । আবার আরেকটা পথ যোশিপুর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে  তুলসীমণি চেকগেট পেরিয়ে , সোজা  দশ কিলোমিটার পিচ বাঁধানো রাস্তায় এসে পৌঁছেছে জামুয়ানি । একদম নর্থ কোর ডিভিশনের গা ঘেঁষে জামুয়ানি গ্রাম । ভারী সুন্দর অবস্থান সেখানকার নেচার ক্যাম্পের । সেখানেও থাকতে পারেন। শেষের একরাত্রি সেখানে ছিলাম আমরা । জামুয়ানি র কিছু অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য । একদম কোর এরিয়ার ভিতরে চাহালা এনিম্যাল সাইটিং পয়েন্ট মাত্র আট কিলোমিটার দূরে । তবে ব্যক্তিগত ভাবে গুরগুড়িয়া নেচার ক্যাম্প আমার অনেক বেশী আরণ্যক প্রকৃতির কাছে মনে হয়েছে । গুরগুড়িয়া তে চারটি সুইট রুম সংবলিত পাইন ভিলা একদম পাইন বনের পাশেই । পাশের ক্যান্টিনে খাওয়া দেওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালো । আর আছে সান্থাল কটেজ ।  আমাদের অরণ্য ভ্রমণ পুরোটাই আব্দুল ওয়াহিদ ঠিক করে দিয়েছিলেন । ঠিক হল সকাল ৬ টা ২০ মিনিটের হাওড়া বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে সকাল দশটার আসে পাশে জামশেদুর পৌঁছব । সেখানে বোলেরো গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করবে আব্দুল ওয়াহিদ । তারপর সোজা যোশিপুর । সেখান থেকে লালমাটির জঙ্গল পথ ধরে , অসাধারণ আরণ্যক প্রকৃতির ভিতর দিয়ে গুরগুড়িয়া নেচার ক্যাম্পে আসব । থাকব তিনরাত আর এক রাত থাকবো জামুয়ানি নেচার ক্যাম্পে । ইকো কটেজ আর সবরকম পারমিটের ব্যবস্থা করে রাখবে ওয়াহিদ জি ।
নির্দিষ্ট দিনে পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাব্বিশ তারিখ দুপুর দুটোর মধ্যে চলে এলাম গুরগুড়িয়া নেচার ক্যাম্পে । পাহাপাশি দুটো সুইট পেলাম আমাদের দুই পরিবারের জন্য ।  


এতটা পথ পেরিয়ে গুড়গুড়িয়ার এই আরণ্যক পরিবেশে এসে যেন স্বর্গীয় অনুভূতি । পাশের পাইন বনের অমোঘ হাতছানি পারলাম না এড়াতে । শীতের দুপুরের তেরছা সূর্যের আলো গাছের ফাঁক দিয়ে নীচে ঝরে পরা শুকনো পাইন পাতার উপরে পড়ছিল । দারুণ একটা বুনো গন্ধ নাকে আসছিল । বুক ভরে শ্বাস নিলাম । বেশ কিছু আলো ছায়ার মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করলাম ।


দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়লাম ওয়াহিদ দার তত্ত্বাবধানে অরণ্য বিহারে । গন্তব্য মেঠো জঙ্গলপথে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে চাহালা এনিম্যাল সাইটিং পয়েন্ট । সিমলিপালের প্রাণী বৈচিত্র্য প্রতক্ষ্য করার সেরা জায়গা নাকি এই চাহালা । ময়ূরভঞ্জ নরেশের মৃগয়া ক্ষেত্র ছিল চাহালা । চাহালার ভি আই পি বনবাংলোয়ে রাজা সদলবলে শিকারে এলে থাকতেন । আমাদের অবশ্য সাইটিং ই একমাত্র ধ্যান জ্ঞান নয় । আমরা তো এসেছি সিমলিপালের মোহময়ী রূপে মজতে , ঝিম ঝিম নেশা ধরানো প্রকৃতির শোভায় বুঁদ হতে , অসংখ্য জলপ্রপাতের আর ঝর্ণার জলে ভিজতে , রাতের মিশকালো আকাশে ঝিঁকি মিকি তারার আলোয় অসীমতা কে অনুভব করতে আর এই নিস্কলুষ প্রকৃতির বুকে কটাদিন কাটাতে ।

প্রায় ১৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ , ৩৬০ প্রজাতির পাখী , ৫৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও বিভিন্ন প্রকারের সরীসৃপ আছে এই বিস্তৃত অরণ্যে । হর্নবিল , রুফাস টেইলড পাখী , এছাড়া স্পটেড ডিয়ার , সম্বর , গউর , বাইসন , হাতী , রয়েল বেঙ্গল টাইগার , লেপার্ড নিয়ে ২৭০০ বর্গকিমি বিস্তৃত সিমলিপাল । এই শতাব্দীর প্রথমদিকে নাকি প্রায় ৯৬ টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ত্ব ছিল । মানুষের যথেচ্ছাচারে , পশু চামড়ার লোভে নির্বিচারে বাঘ মারার ফল সেই সংখ্যাটা নামতে নামতে সাতাশে এসে দাঁড়ানো । অতএব ২৭০০ বর্গকিলোমিটার ব্যাপ্ত এই বিশাল অরণ্য প্রান্তরে মাত্র ২৭ টি বাঘের উপস্থিতির জন্য যে বাঘদর্শন প্রায় দেব দর্শণের সমতুল্য হবে , সেটা সহজেই অনুমেয় । আমাদের ভাগ্যে শিঁকে যদিওছিড়েছিল কিছুটা লেপার্ড সাইটিংয়ের মাধ্যমে । লেপার্ড সিমলিপালে আছে প্রায় ৬১ টি । চাহালায়ে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছিল । গুড়গুড়িয়া থেকে জঙ্গলের পথ ধরে চাহালা যাবার রাস্তাটা ভারী চমৎকার । মাঝে মাঝেই দূরে দেখা যায় অনুচ্চ পাহাড় । পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তীর্ন অংশে চাষের জমি । ধান , সর্ষে , বিভিন্ন রকমের সব্জীর চাষ হচ্ছে । বেশ কয়েকটা ছোট গ্রাম পড়ে যাবার পথে । খড়ে ছাওয়া ঘর , বাড়ীর সামনে নিকানো উঠোন , উঠোনে সদ্য কাটা ধান শুকোতে দেওয়া । অনেকের বাড়ীর মাটির দেওয়ালের গায়ে সুন্দর চিত্রকলা । প্রায় প্রতিটা গ্রামেই সৌরবিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেল দেখলাম । কিছু জায়গায় আবার প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রও দেখলাম । ভারতের অন্যান্য জায়গায় এরকম গভীর অরণ্যের ভিতরে , কোর এরিয়ার এত কাছে গ্রাম থাকে বলে শুনিনি , দেখিওনি । শুনলাম সরকার থেকে পুনর্বাসনের জন্য সবরকম চেষ্টা হচ্ছে , নিকটবর্তী শহরে জমি থেকে শুরু করে , উপযুক্ত আর্থিক সাহায্য । কিন্তু এরা আদিবাসী , যুগযুগান্তর ধরে অরণ্যবাসী , জঙ্গল ছেড়ে যেতে এরা বেশীরভাগ ই ইচ্ছুক নন । জংলী জীবজন্তুদের সাথে সহাবস্থান এদের । বন দপ্তর থেকে বিভিন্ন সচেতনামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই আদিবাসীদের প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের ব্যাপারে অংশগ্রহণ করানো হয়েছে । এই সব গ্রামের আদিবাসীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বনদপ্তরের ইকোট্যুরিজমের বিভিন্ন নেচার ক্যাম্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । এতে আদিবাসীদের জীবন , জীবিকা অক্ষুন্ন রেখেও বন সংরক্ষনের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে । সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের এই সব উদ্যোগ যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে ।


গ্রাম ছাড়ালেই জঙ্গলের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য মোহিত করে । প্রধানতঃ শালের জঙ্গল , এছাড়াও আছে.খয়ের , শিশু, শিমুল , আম, জাম ইত্যাদি  । শীতের জঙ্গলে সন্ধ্যে নেমে আসে বড় তাড়াতাড়ি । চাহালা আসার একটু আগেই বৃন্দাবন ফরেস্ট চেক গেট । বৃন্দাবন গেট পেরিয়েই গাইড ওয়াহিদ দা সার্চ লাইটের আলো ফেলে জীপের গতি খুব কমিয়ে এগোতে লাগলো । নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চলল ফিসফিসিয়ে । শুনলাম সব চেয়ে বেশী টাইগার আর লেপার্ড সাইটিং হয় এই অঞ্চলে । খানিক এগিয়ে বোলেরোর স্টার্ট বন্ধ করে , হেডলাইট নিভিয়ে চুপ করে বসে রইলাম আমরা । যেকোনো মুহূর্তে সাইটিংয়ের সম্ভাবনা । তখন ছিল অমাবস্যা । চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার । কোর এরিয়ার ভিতর শ্বাপদ সংকুল পরিবেশে এইভাবে চুপ করে বন্য জন্তু দেখার অপেক্ষায় বসে থাকার অনুভূতিই আলাদা , সেটা যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারাই বুঝবেন । কতক্ষন সবাই মিলে চুপ করে বসেছিলাম খেয়াল নেই । হঠাৎ ড্রাইভার সিট থেকে ওয়াহিদ দা বলে উঠল ” ওই দেখুন , মোবাইল বার করুন ,বড়জোর দেড় বছর বয়েস হবে । এর মা নিশ্চয়ই কাছে আছে ” । উত্তেজনায় সাথে সাথে ক্যামেরা বা মোবাইল বার করতে ভুলে গিয়েছিলাম । সার্চ লাইটের আলোয় দেখি একটা ছোট লেপার্ড হেলতে দুলতে ডানদিকে রাস্তার ধারের নালা পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে ঢুকে যাচ্ছে । ভালো করে সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে করতেই লেপার্ড বাবাজি জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেল । পুরো মুহূর্ত টা বড়জোর মিনিটখানেক স্থায়ী ছিল । ” যাক প্রথম দিনেই ব্যাঘ্র দর্শন হল , হলেও বা সেটা লেপার্ড “ একযোগে বলে উঠল ঋতু , আমার স্ত্রী আর পিউ , আমার বন্ধু পত্নী । “ ম্যাডাম , আজকে কিন্তু আরেকবার টাইগার সাইটিং হতে পারে , নাটক কিন্তু এখনো বাকী আছে । এর মা টা কাছে পিঠেই থাকবে “ ।বলল ওয়াহিদ দা । এরপর একদিকের সার্চ লাইট ধরল ওয়াহিদ দা আর আরেকদিকে সার্চ লাইটের আলো ফেলতে থাকল ধ্রুব , আমার বন্ধু । বেশ খানিকক্ষণ এভাবে লেপার্ড খোঁজার পর্ব চলল জঙ্গলপথে । তারপর রণে ভঙ্গ দিলাম আমরা । ” আজ আর টাইগার সাইটিং হবেনা মনে হচ্ছে , চলুন ওয়াহিদ দা , চাহালার দিকে যাই এবারে ” বলি আমি ।

এরপর এলাম ঘন অন্ধকারে চাহালায়ে । সোলার সেলের টিমটিমে আলো বনদপ্তরের চত্বরে । মনে মনে দারুণ উত্তেজনা । এতদিন বুদ্ধদেব গুহর বিভিন্ন লেখায় বিশেষ করে “অন্য চোখে ” বইতে  “ভয়ঙ্কর সুন্দরী ” লেখায় চাহালা নিয়ে পড়ে এসেছি । সেই বনবাংলো যেখানে ময়ূরভঞ্জের রাজা এলে থাকতেন , যার সামনে হাতীর হাত থেকে বাঁচার জন্য পরিখা কাটা আছে । সামনেই ইউক্যালিপটাসের বন , যেখানে প্রচূর হরিণ চড়ে বেড়ায় , মাঝে মাঝে দুই একটা হাতীও । অন্ধকারে বিশেষ কিছু ঠাহর করতে পারলাম না , তবে সার্চ লাইটের আলোয় সবুজ জ্বল জ্বল করা বেশ কিছু হরিণের চোখ দেখলাম । রাতের জঙ্গলে সেই দৃশ্য চোখে দেখার অনুভূতি অনবদ্য , কিন্তু যেটা অসহ্য লাগলো তা হচ্ছে বড়দিনের ছুটিতে আসা একগাদা পর্যটকদের সম্মিলিত কলতান । জঙ্গল কে যে নিঃশব্দে অনুভব করতে হয় তা কে বোঝাবে এদের !! এখানেই রয়েছে বনদপ্তরের বাংলো , আগে অনুমতি মিললেও এখন আর এখানে রাত্রিবাসের ছাড়পত্র পাওয়া যায়না । একটু রাত করে এরপর ফিরে এলাম গুড়গুড়িয়া ।

On the way to Chahala from Gurguria


পরেরদিন তুলনামূলক ভাবে পর্যটকদের কাছে স্বল্প পরিচিত এক জলপ্রপাত দর্শনে এলাম সবাই মিলে গুড়গুড়িয়া থেকে চার কিলোমিটার দূরে কুমারী নেচার ক্যাম্প , আর সেখান থেকে খানিক দূরে । গ্রামের প্রান্তে গাড়ী রেখে প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটা পথে অসুরখাল নামে এক অনবদ্য জলপ্রপাত ।

দেশ বিদেশের কত বিখ্যাত জলপ্রপাত এর আগে দেখেছি , কিন্তু উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ জেলার সিমলিপাল অরণ্যে কোর এরিয়ার প্রান্তে অবস্থিত অনামী এক ঝর্ণা ও অসুরখাল জলপ্রপাতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য মনের উপরে দারুন অভিঘাত ফেলল । ছবির মতন সুন্দর দৃশ্যপট । সৃষ্টিকর্তার কি অপরূপ এক সৃষ্টি । চারিদিকে ঘন জঙ্গলের ভিতরে অনেক উঁচু থেকে পরিষ্কার টলটলে বিপুল জলধারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচের বড় বড় বোল্ডারে , তারপর সেখান থেকে আরো বেশ কিছু ছোট বড় পাথরে গড়িয়ে ঝর্ণা হয়ে সেই জলরাশি কুল কুল করে নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে । আঃ , এমন জায়গাতে সারাদিন কাটাতে মন চায় । অসুরখাল আসার পথ টাও অপূর্ব । বেশ খানিকটা আদিবাসীদের গ্রামের ভিতর দিয়ে হেঁটে এসে অনেকটা খোলা জায়গা । তিনদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা । মাঝের উপত্যকার শুরুর দিকটা বেশ খানিকটা চাষের জমি । আলপথ ধরে এগোতে হয় । খানিক এগিয়ে জঙ্গলের মোহময়ী রূপ দৃশ্যমান হয় । একটা ছোট খাল পেরিয়ে যত অসুরখালের দিকে পথ এগোয় জঙ্গল তত গভীর হতে থাকে । সরু পায়ে চলা পথের দুপাশে ঘন জঙ্গল । ক্রমশঃ জল পড়ার আওয়াজ বাড়তে থাকে । তারপর হঠাৎ ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে ফুটে ওঠে অনামী এই জলপ্রপাতের  স্বর্গীয় দৃশ্য ।
চ্যাটালো একটা পাথরের উপরে বসলাম বেশ খানিকক্ষণ । একদম নিরালা পরিবেশ । পর্যটদের ভীড় নেই । এ যেন আমাদের প্রাইভেট স্নানাগার সাথে জাকুজি । বন্ধু ধ্রুব আর গাইড ওয়াহিদ বাবু বেশ খানিকটা উপরে উঠে ঝর্ণার উপরের দিকে পাথরের আড়ালে স্নান করল । ছোটরা আর বড়রা নিজেদের মতন উপভোগ করল । আমি চুপ করে অনেকক্ষণ বসেছিলাম সেই পরিবেশে । হালকা হাওয়া বইছিল , সূর্যের আলো এসে পড়ছিল চ্যাটালো কালো পাথরে । একটু দূরে ঝর্ণার জল পড়ার তীব্র শব্দ । পাখীর ডাক কানে আসছিল কিছু । নাকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছিল । ভারী ভালো লাগছিল এই পরিবেশ । কতক্ষণ যে কেটে গেল এভাবে কে জানে । সম্বিৎ ফিরল ঋতুর ডাকে ” কি গো , চল এবারে ফিরি ” । তাকিয়ে দেখি ধ্রুব আর পিউ ব্যাগ গুছিয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে । ঝর্নার প্রাকৃতিক পরিবেশে স্নান করে ধ্রুব একদম ফ্রেশ । বাচ্চারা অবশ্য কিছুতেই যেতে চাইছিল না এই পরিবেশ ছেড়ে । বুঝলাম এই অনবদ্য প্রকৃতির প্রভাব শিশু মনেও যথেষ্ট পড়েছে । সব ভালো মুহূর্তেরই যেমন শেষ আছে , তেমনি অনামী অসুরখালের ধারে কয়েকঘন্টা কাটানোর এই মুহূর্তও শেষ হয়ে এলো দ্রুত , তবে স্মৃতিটা থেকে যাবে সারাজীবন ।

On the way to Asurkhal Waterfalls 1
অসুরখালের ছবিগুলি


বিকেলে এলাম গুড়গুড়িয়া থেকে তেরো কিলোমিটার দূরে উস্কি জলপ্রপাতে । ভারী সুন্দর দৃশ্য । পাথর বেয়ে উঠলাম জলপ্রপাতের মাথায় । সেখান থেকে দেখতে পাওয়া ঘন জঙ্গলের দৃশ্য চমৎকার । ওয়াহিদ দার কাছে শুনলাম পাথর বেয়ে আরো বেশ কিছু উঠলে আরো তিনখানা ঝর্না আছে জঙ্গলের গভীরে ।

Uski
উস্কি জলপ্রপাতের ছবিগুলি


পরেরদিন প্রাতরাশ সেরেই চললাম বিখ্যাত বারেহিপানি ফলস দেখতে । পঁচিশ কিলোমিটার পথ । লালমাটির পথে , শালবন পেরিয়ে , কয়েকটা আদিবাসী গ্রাম তারপর বেশ খানিকটা পাহাড়ী পাকদন্ডী পথ পেরিয়ে এসে পৌঁছোই বারেহিপানি জলপ্রপাতে । তেরোশো নয় ফুট উঁচু থেকে বিস্তীর্ন জলধারা দুই স্তরে আছড়ে পড়ছে নীচে আর সৃষ্টি করেছে বিখ্যাত বুড়িবালাম নদী যা বয়ে গিয়ে চাঁদিপুরে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে । ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম জলপ্রপাত হচ্ছে এই বারেহিপানি । স্থানীয় ভাষায় বারেহি মানে হল দড়ি । মোটা দড়ির মতন জলধারা নীচে আছড়ে পরে দেখে এই জলপ্রপাতের নাম হয়েছে বারেহিপানি ।


পার্কিং লট থেকে একটু এগোতেই দেখি কংক্রিটের লগ হাউস । ফরেস্ট বাংলো । সামনে বাঁধানো চত্বর , তারপরেই বেড়া দেওয়া আর ওপারে গভীর গিরিখাত । গিরিখাতের ওপারেই পাহাড় থেকে নেমে আসছে বারেহিপানি জলপ্রপাত । এই সেই বিখ্যাত ফলস যার কথা অনেক শুনেছি । বুদ্ধদেব গুহ র লেখাতে পড়েছি রাতে ফলসের উপরে অনেক আলো জ্বলতে নিভতে দেখা যায় , আর এই লগ হাউস বা ফরেস্ট বাংলোর ব্যালকনি তে বসে সামনে বিস্তৃত জলপ্রপাতের শোভা অনবদ্য লাগে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে পাশাপাশি দু কামরার এই বাংলো । আগে এখানে কাঠের লগ হাউস ছিল , পরে এই কংক্রিটের লগ হাউস বানায় বনদপ্তর । আজকাল আর এই বাংলোয়ে থাকার অনুমতি মেলেনা ।

in front of Barehipani waterfalls
বরেহিপানির ছবিগুলি

বারেহিপানি থেকে এরপর চললাম জোরান্ডা জলপ্রপাতের দিকে । চব্বিশ কিলোমিটার পথ । গুড়গুড়িয়া থেকে মোট ঊনপঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে জোরান্ডা । বারেহিপানি থেকে জোরান্ডার পথ সব চেয়ে নয়নাভিরাম । লাল মাটির পথ । শালের জঙ্গল । মাঝে রয়েছে শিমুল , শিশু , গামার , আম , জাম । জঙ্গল কোথাও ঘন , কোথাও পাতলা হয়ে এসেছে । মাঝে পড়ল নুয়ানা উপত্যকা । অপরূপ সেই দৃশ্য । ঢেউ খেলানো মাঠ , অনেকটা বিস্তৃত ফাঁকা উপত্যকা । সেখানে চাষবাস হচ্ছে । সদ্য ধান কাটা হয়ে গেছে । বেশ বড় গ্রাম এখানে অন্য গ্রামের তুলনায় । আদিবাসী গ্রামে সাঁওতাল , ওঁরাও , মুন্ডা . বাথুরী ইত্যাদি আদি জনজাতির বাস । প্রায় একষট্টি টি আদিবাসী গ্রাম আছে সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে । দুদিকে পাহাড় দেখা যাচ্ছে । গাইডের কাছে শুনলাম , এর আগে শ্রী বুদ্ধদেব গুহর লেখায় ও পড়েছি এই নুয়ানা উপত্যকায় বসবাস ও চাষাবাদ করতে বছরে ন আনা খাজনা দিতে হত এখানকার অধিবাসীদের । সেই থেকে এই জায়গার নাম নুয়ানা । ওঁনার লেখায় পড়েছি নুয়ানায় বেশ খানিকটা উঁচুতে টিলার ওপর সুন্দর ফরেস্ট বাংলো আছে । সেই বাংলো একবার চাক্ষুষ করব বলাতে ওয়াহিদদা বলে সেখানে এখন যাবার অনুমতি মেলেনা , সি আর পি এফের ক্যাম্প হয়েছে সেখানে । একটু চোখের দেখা দেখব বলে পীড়াপীড়ি করাতে গাইড শেষ মেষ নুয়ানা ফরেস্ট বাংলোর সামনে নিয়ে আসে । বাংলোর সামনে উঁচু ওয়াচটাওয়ার । জায়গাটা একদম ফাঁকা । ভারী সুন্দর অবস্থান এই বাংলোর । উপর থেকে উপত্যকা টা সুন্দর দেখা যায় ।

Nuwana Valley
নুয়ানা উপত্যকা র ছবি গুলি


নুয়ানা ছাড়িয়ে এরপর খানিক এগিয়ে খৈরী নদীর ধারে বালির চরে একজায়গায় পিকনিক লাঞ্চ সারা হল । সে এক দারুন অভিজ্ঞতা । অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য কে সাক্ষী রেখে এরপরে চলে এলাম জোরান্ডা ফলসে ।

গাড়ী থেকে নেমে খানিক পথ হেঁটে চলে এলাম পুরোনো বনবাংলোর সামনে । একদম খাদের কাছে । পাশেই দেখা যাচ্ছে জোরান্ডা জলপ্রপাত , প্রায় চারশো নব্বই ফিট উঁচু । এই বাংলোয়ে আজকাল আর থাকার অনুমতি মেলেনা । কল্পনা করলাম বিশ ত্রিশ বছর আগে এলে এই জোরান্ডা বাংলোয়ে রাত্রিবাস করা যেত । জ্যোৎস্না রাতের মায়াবী আলোয় এই বাংলোর বারান্দায় বসে পাশেই গড়িয়ে পরা জলপ্রপাতের দৃশ্য না জানি কত মোহময়ী লাগত । পেছনের ঘন শালবন নরম আলোয় ভেসে যেত । ওখানেই একটা ওয়াচটাওয়ার আছে । সেখান থেকে না জানি কত জন্তুই দেখা যেত । এইসব অনবদ্য ফরেস্ট বাংলো গুলি যা সিমলিপালের গভীর অরণ্যের ভিতরে তা সব ই আজকাল পর্যটকদের কাছে অগম্য । ভাবলেও খারাপ লাগে । এর জন্য বোধহয় আমরা ই দায়ী । পরিবেশ সংরক্ষণ বজায় রেখে , আরন্যক প্রকৃতিকে ন্যূনতম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে জঙ্গলে ভ্রমণের নির্যাস টা বোধহয় আমরা নিতে পারিনি । তাই জঙ্গল কে বাঁচাতে , তার প্রাণী বৈচিত্র্য কে বাঁচাতে নির্বিচারে অরণ্যের গভীরে পর্যটনের ছাড়পত্র বন্ধ করা হয়েছে । সামগ্রিক ভাবে এই ব্যাঘ্র প্রকল্পের সংরক্ষণ কার্যকলাপ যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে । গাইডের মুখে শুনলাম সাউথ কোর ডিভিশন পুরোটাই সারা বছর পর্যটকদের কাছে অগম্য । জেনাবিল , বরাকামরা , কিংবা সিমলিপালের উচ্চতম স্থান মেঘাসিন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরপুর জায়গাগুলি কোনোটাই এখন আর যাওয়া যায়না , অনুমতি মেলেনা । শুনলাম এশিয়ার একমাত্র মেলেনিস্টিক টাইগার বা কৃষ্ণকায় বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র হচ্ছে এই সিমলিপাল । একমাত্র সাউথ কোরে বর্তমানে তিনটি মেলানিস্টিক টাইগার অবশিষ্ট আছে । তাদের সংরক্ষণের উদ্দেশেই এই নিষেধাজ্ঞা ।

Bridge leading to Joranda falls
জোরান্ডার ছবিগুলি


বরেহিপানি , জোরান্ডা দেখে গুড়গুড়িয়ায় ফিরতে দেরি হল । রাতের ডিনার হল জম্পেশ । গাইড এর হাতের রান্না চমৎকার । রুটি , ডাল , মিক্সড ভেজ , দেশী চিকেনের পদ মেথি চিকেন সহযোগে তৃপ্তির ডিনার সারা হল । অদ্যই গুড়গুড়িয়ায় আমাদের শেষ রজনী । ডিনারের পর ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে ঘাড় তুলে দেখি আকাশভরা তারা । রাতের অরণ্য বড়ই নিশ্চুপ । একদম নিঃশব্দ পরিবেশ । তার উপরে অমাবস্যা । পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্না ভেজা জঙ্গল অনেক কথা বলে কিন্তু অমাবস্যার রাতের সিমলিপালের সাউথ কোরের প্রান্তে গুরগুড়িয়ার এই অরণ্য প্রকৃতি অস্বাভাবিক রকম শান্ত । শুধু বনদপ্তর যদি নেচার ক্যাম্পের চত্বর টা রাতে একটু কম আলোকময় করত তাহলে প্রকৃতির রূপ আরো একটি ফুটে উঠত আশা করি । সোলারের আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক টা। আকাশের দিকে চাইলে দেখা যায় শতসহস্র নক্ষত্র । লক্ষ কোটি বছর আগেও এভাবেই আকাশ ভরা নক্ষত্র বিরাজ করত এখানে ।  কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে মোহিত হওয়ার মতন ছিলনা কেউ সেই প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশে । তারপর লক্ষ বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের আবির্ভাব । ভাবতে শিখল , চিন্তা করতে শিখল সে । সিমলিপালের গহীন বনে তারাভরা এই আকাশ দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতন জীব আবির্ভূত হল এই পৃথিবীতে । আর মানুষের যুক্তিপূর্ণ চিন্তা আর উদ্ভাবনী শক্তির উপর ভর করে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হল । সভ্যতার বিকাশ হল । অরণ্যপ্রকৃতি  তার আদিমতা হারালো । জঙ্গল কেটে চাষাবাদ হল , মানুষের বসবাস হল । সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে প্রকৃতিও ধ্বংস হল কিছুটা । আসলে কতটা অগ্রগতি , প্রকৃতির সামঞ্জস্য ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সম্ভব সেই পরিমিতি বোধ ক্রমশঃ গেল হারিয়ে । পৃথিবীটা যে মানুষ ছাড়া অন্য প্রজাতির প্রাণীকুলেরও সেটাই ভুলে গেল মানুষ । আর এই সবকিছুর , আর আরো অনেক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী থেকেছে সিমলিপাল । অষ্টাদশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে একবার আলীবর্দী খাঁ ময়ূরভঞ্জ দখলের জন্য সৈন্যসামন্ত নিয়ে হাজির হন । রাজধানী হরিপুরে আনন্দ ও চিত্তবিনোদনে নিমগ্ন রাজা জগর্ধর ভঞ্জ তখন সপার্ষদ সিমলিপালের গহীনে পাহাড় জঙ্গলে আশ্রয় নেন । একইভাবে ১৭৫১ সনে মারহাট্টা সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের সময়েও ময়ূরভঞ্জের রাজা লোকচক্ষুর অন্তরালে এই সিমলিপালেই আশ্রয় নেন । এরপর ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রিন্সলি স্টেট্ ময়ূরভঞ্জ তথা এই বিশাল পাহাড় জঙ্গল নিয়ে বিস্তৃত সিমলিপাল উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় । নির্বিচারে শিকার আর বন্ নিধন এরপর বাধ্য করে সিমলিপাল কে ব্যাঘ্র প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতে । ১৯৭২ সালে ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন এক্ট লাগু হয় । প্রকৃতি সংরক্ষণ নিয়ে মানুষের ভাবনাচিন্তা শুরু হয় । কিছুটা বোধহয় হুঁশ ফেরে , কিন্তু সেটা কি যথেষ্ট ? মানুষ সচেতন না হলে প্রকৃতির ভারসাম্য বোধহয় রাখা আর যাবেনা । এই সব এলোমেলো ভাবনা চিন্তায় কেটে গেল খানিক সময় । রাত বাড়লে এরপর রুমে ফিরে এলাম ।

Sunday flea market or haat at Gurguria
গুরগুরিয়ার ছবিগুলি

কুয়াশামাখা শীতের ভোরের জঙ্গল বড়ই ঝিমধরা । পাখীর ডাক ও বেশী নেই । ভোরের সেই ঘুমন্ত পরিবেশে আমি আর বন্ধুবর ধ্রুব পাইন বনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের গভীরে এসে পড়লাম । এদিকে ঘন শালের জঙ্গল । ওয়াহিদ দা ও আমাদের সাথে যোগ দিল । শিশির ভেজা পথ দিয়ে চললাম আমরা । নানা বিষয়ে কথাবার্তা চলছিল নিজেদের মধ্যে । শুনলাম বাঘ শুমারি , মানে বাঘের পা এর ছাপ বা পাগমার্ক থেকে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করার পদ্ধতি ভারতে প্রথম প্রচলন করেন শ্রী সরোজ চৌধুরী । দেরাদুনের ফরেস্ট রিসার্চ সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ অফিসার ছিলেন তিনি , পরে ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা ও ফিল্ড ডিরেক্টর হিসেবে ছিলেন কর্মরত । খৈরী নদীর ধার থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একে ব্যাঘ্র শাবক কে নিজের কাছে এনে সন্তানসম মানুষ করেন ও বড় করে তোলেন । সেই গল্প তখন মিডিয়ায় যথেষ্ট আলোচিত হয় । খৈরী নদীর ধার থেকে পাওয়ার জন্য ওই বাঘের নাম দেন তিনি ” খৈরী ” । পোষ মানা বাঘ ” খৈরী ” যোশীপুরে ওনার কোয়ার্টারে ঘুরে বেড়াত । পরে এক কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হলে নিজের হাতেই খৈরী কে নিধন করেন যন্ত্রনা র হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য । বাংলোর লনেই এরপর খৈরী কে কবর দেওয়া হয় । এরপরে খুব বেশীদিন আর বাঁচেন নি সরোজ বাবু । এই সব নানা গল্প করতে করতে চলে এলাম খৈরী নদীর পাড়ে । অপূর্ব দৃশ্যপট । যেন রং তুলিতে আঁকা ছবি । নদীখাতে ছোট , মাঝারি বোল্ডার পাথর । কূল কূল শব্দে বয়ে চলেছে নদী । নদীর ওপারে জঙ্গল । নদীর পাড় থেকে পায় চলা পথ গেছে গুড়গুড়িয়া ক্যাম্পের দিকে । সেই পথেই একটু এগিয়েই গুড়গুড়িয়া অর্কিডেরিয়াম । প্রায় তেষট্টি রকম বিভীন্ন এক্সোটিক অর্কিডের সমাহার এখানে । কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দী করে ফিরে এলাম আবার ক্যাম্পে ।


প্রাতরাশের পর গুড়গুড়িয়াকে বিদায় জানিয়ে চললাম যোশীপুর হয়ে জামুয়ানি । মাঝে যোশীপুরে রামতীর্থ কুমীর প্রকল্প ঘুরে তুলসীমণি গেট পেরিয়ে জামুয়ানি পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল ।

জামুয়ানি নেচার ক্যাম্প অনেক বেশী সাজানো গোছানো । বাচ্চাদের খেলার পার্ক , টেবিল টেনিস কোর্ট , ব্যাডমিন্টন কোর্ট , ফুলের বাগান সব মিলিয়ে জমজমাট আয়োজন । আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সানথাল কটেজে । ভিট্রিফায়েড টাইলসের মেঝে, ঝকঝকে আসবাবপত্র , এসি , বাথরুমে গিজার সহ পরিপূর্ন ব্যবস্থা । ব্যক্তিগত ভাবে আরণ্যক পরিবেশে এত সাজানো গোছানো আয়োজন আমার খুব একটা ভালো লাগেনা । সেই তুলনায় গুড়গুড়িয়া ক্যাম্প অনেক বেশী প্রকৃতির কাছে বলে আমার মনে হয়েছে । আসলে জঙ্গলে থাকার আসল মজা মোটা দেওয়ালের বড় থাম ওয়ালা , সামনে খোলা বারান্দা যুক্ত ফরেস্ট বাংলোয় । কিন্তু আজকাল সিমলিপালে তো তা হওয়ার নয় তাই এই অধিক সাচ্ছন্দ যুক্ত রিসোর্ট মার্কা নেচার ক্যাম্প ই ভরসা । তবে অনেকেরই অবশ্য এই ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো লাগবে ।

Santhal Cottage at Jamuani Nature camp
জামুয়ানির ছবিগুলি


বিকেলে শেষবারের মতন আবার এনিম্যাল সাইটিংয়ে বেরোনো হল চাহালার উদ্দেশ্যে । আজই সিমলিপালে আমাদের শেষ রাত । বিকেল থেকে চাহালায়ে বেশ কিছু হরিণ দর্শণ হল । ফেরার পথে নির্জন পথের বাঁকে অন্ধকারে গাড়ীর ভিতর অপেক্ষা করে দেখা হলনা কোনো জন্তুই । সে যাইহোক সম্পূর্ণ পরিবেশের যা প্রভাব পড়ল মনে তা বলার নয় । পরিপূর্ন তৃপ্তি নিয়ে ফিরে এলাম জামুয়ানি ।
পরেরদিন সিমলিপাল কে বিদায় জানিয়ে ফিরতি পথে জামশেদপুর থেকে ট্রেন ধরে আবার কলকাতায় ফেরা । পেছনে পরে রইল সিমলিপালের স্বপ্নের জগৎ ।

সিমলিপাল অরণ্য ভ্রমণের প্রয়োজনীয় তথ্য –

https://www.polarsteps.com/Exoticbongfamilytraveller/4505840-a-call-of-wild-a-trip-to-simlipal-tiger-reserve

Read More Blogs

1 Comment

  1. Debanjan Pan

    Anek kichu ajana tothyo janlam.
    Chamatkar lekha
    Simplipal niye ato bishad barnona agey porini

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।