অশান্ত বলকান

সময়-  জুন-জুলাই ২০০৬   যাত্রীগণ – দেবাশিস দাশগুপ্ত ও অফিসের সহকর্মীরা

লেখা ও ফটো – দেবাশিস দাশগুপ্ত    

স্থান – সারায়েভো, জেনিচা, ত্রাভনিক, মোস্তার ও ভিসোকো

প্রথম পর্ব

  দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে প্রায় ৮ বছর বাদে আবার কর্মোপলক্ষ্যে পা রাখলাম পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ার একটা প্রদেশে যার বর্তমান নাম বসনিয়া- হার্জেগোবিনা । ২০০৬ সালে দাঁড়িয়ে বোঝা সম্ভব নয় যে নব্বইর দশকে এ দেশ ছিল গৃহযুদ্ধে জর্জরিত – ত্রাসের রাজত্ব। অবশ্য আজকে সে কথা অপ্রাসঙ্গিক। সেই গৃহযুদ্ধের স্মৃতি এখন অনেকটাই ম্লান, মনের ক্ষতর ওপরে পড়েছে সময়ের প্রলেপ। এয়ারপোর্টের থেকে আসার পথে গতবার রাস্তার পাশের বাড়ী গুলি দেখেছিলাম বুলেটের ক্ষত আর গ্রেনেডের ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এখন সেখানে ঝাঁ চকচকে মার্কেটিং কমপ্লেক্স। লোকের মনে যুদ্ধ পরবর্তী বিহ্বলতা এবং অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে, যদিও দারিদ্র্য এবং বেকারি এখনও অনেকটাই প্রকট এবং দেশের অর্থনীতির অবস্থা বেশ টালমাটাল।

বিগত নব্বইয়ের দশকে খবরের কাগজে এবং টিভির পর্দায় এই দেশের নাম প্রায়ই উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে। ধর্ম ও জাতি বিদ্বেষ যে কোটি কোটি প্রাণ ছিনিয়ে নিয়েছে  আরব-ইজরায়েল, ভারত-পাকিস্তান এইসব দেশে  বসনিয়ার ঘটনা তারই একটি সংযোজন। সেই জাতি বিদ্বেষের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে  তখন বসনিয়া, কসোভো, আলবেনিয়া, মন্টিনিগ্রো – অশান্ত বলকান অঞ্চলের এই নাম গুলি ছিল মিডিয়ার কল্যাণে  বহুশ্রুত। বলকান অঞ্চলের অতীতও কম ঘটনা বহুল নয়। এখানকার  মাটিতে কান পাতলে শোনা যাবে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ এবং হাওয়ায় ভেসে আসবে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেই চতুর্দশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী – ৭০০ বছরের সুদীর্ঘ  ইতিহাস, যার পাতায় পাতায় অনেক অজানা কাহিনী লেখা আছে বহির্বিশ্বের  মানুষ যার খবর রাখেনা। এই দেশের উপর কে আঘাত হানে নি? অতীতে এই দেশ বাইজান্টাইন, অটোম্যান ও অস্ট্রো-হাঙ্গারীয় সাম্রাজ্যের দখলে ছিল এবং সাম্প্রতিক কালে সহ্য করতে হয়েছে সার্ব ও  ক্রোয়েটদের আঘাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বসনিয়া অঞ্চল অস্ট্রো-হাঙ্গারীয় সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সার্বিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ এপ্রিল সারায়েভো একটি সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য দ্বারা অবরুদ্ধ হয়েছিল যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রু-অধিকৃত পূর্ব ইউরোপের যুগোস্লাভিয়ায় সংগ্রামরত ছিল । যুদ্ধের শেষে ফেডারেল পিপলস রিপাবলিক অফ যুগোস্লাভিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৪৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নতুন দেশের ছয়টি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়।যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা একটি অনন্য সংঘবদ্ধ রাজ্য ছিল যার প্রভাবশালী কোন জাতিগত গোষ্ঠী ছিল না।

 কিন্তু রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে কম্যুনিস্টদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অনেক দেশের মত বসনিয়াও তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সেই জন্মলগ্ন থেকেই সার্ব, ক্রোয়েট এবং মুসলিমদের মধ্যে জাতি বিদ্বেষের আগুন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যদিও এখানকার লোকেদের কাছে শোনা যে আগে ধর্ম নিয়ে এদেশে কোন বিরোধ ছিলনা। এদেশের জনসাধারণের মধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম এবং বাকীরা অর্থাৎ সার্বরা অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান এবং ক্রোয়েটরা রোমান ক্যাথলিক।

১৯৯১ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার অঞ্চলগুলিতে সার্ব জনগোষ্ঠী স্বঘোষিত সার্ব স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করেছিল। পরে প্রমাণিত হয় যে সার্বিয়ার যুগোস্লাভ পিপলস আর্মি বেলগ্রেড থেকে বোসনিয়াক সার্বদের গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করছিল। ১৯৯২  সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় কমিউনিটি বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্বাধীনতা স্বীকৃতি দিলে বসনিয়ার সার্ব আধাসামরিক বাহিনী সারায়েভোর উপর গুলি চালানো শুরু করে এবং যুগোস্লাভ সেনাবাহিনীর সহায়তায় বসনিয়ার সার্ব ইউনিটগুলি এই শহরটিতে আর্টিলারি বোমা হামলা শুরু করে। পূর্ব বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনার অনেকগুলি শহরে স্থানীয় বোসনিয়াক জনসংখ্যার বেশিরভাগকে বহিষ্কার করা হয়েছিল জাতিগত নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়াটি কার্যকারী করার জন্য। যদিও বোসনিয়াকরা এর শিকার এবং সার্বরা প্রাথমিকভাবে অপরাধী ছিল, কিন্তু এই অপরাধীদের মধ্যে ক্রোয়েটরাও ছিল। এদিকে আমেরিকা এই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বাড়াতে ক্রোয়েট এবং মুসলিমদের পেছনে দাঁড়াল। এই সুযোগে পোয়াবারো হয়েছিল অস্ত্র ব্যবসায়ীদের। একদিকে ইরান, তুরস্ক এবং অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং অপর দিকে রাশিয়া অস্ত্র প্রতিযোগীতায় নেমে পড়ল। রাজায় রাজায় যুদ্ধ চলল – উলুখাগড়ার প্রাণ গেল। সীমান্তের ওপার থেকে আসা অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত হয়ে মধ্য-বসনিয়ার মুসলিম বাহিনী এবারে সার্ব দের উপরে আঘাত হানল। আমেরিকা এবং ক্রোয়েটদের সম্মিলিত শক্তি সারায়েভো থেকে সার্বদের বিতাড়িত করল। প্রায় দুই লক্ষ সার্ব বাহিনী যারা প্রায় দীর্ঘ তিন বছর ধরে আক্ষরিক অর্থে সারায়েভোকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল বাইরের বিশ্ব থেকে, তারা অবশেষে দেশ ছাড়ল – সারায়েভো হল মুক্ত।

 বসনিয়া স্বাধীন হবার পর যুদ্ধোত্তর এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৫ সালে। তার ফলে ক্রোয়েট, মুসলিম ও সার্বদের কোয়ালিশন সরকার দেশ শাসন করবে বলে ঠিক হয়। এই চুক্তি তৎকালীন ইউরোপীয় কমিউনিটি এবং ন্যাটোর যৌথ উদ্যোগে সম্পাদিত হয়।কিন্তু ততদিনে কয়েক লক্ষ লোক গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে, প্রায় কুড়ি লক্ষ লোক হয়েছে উদ্বাস্তু এবং বহু লোকের কোনও খোঁজই পাওয়া যায়নি।

#4 Sarajevo- the mass burial ground of war victims

 রাজনীতিবিদদের দাবার চালে সবার আগে তো বোড়েরাই সাবাড় হবে এবং সব শেষে  সকৌশলে  কিস্তিমাত। ইতিহাস বোধ হয় বারে বারে এই ভাবেই ফিরে আসে। আমরাও তো একই চক্রান্তের শিকার হয়েছি। আমাদেরও এই ভাবে খেসারত দিতে হয়েছিল এবং এখনও দিতে হচ্ছে। ধর্মীয় এবং বিভেদকামী  শক্তিগুলি এবং সন্ত্রাসবাদীদের রোষের বলি হচ্ছে সাধারণ অসহায় নাগরিকেরা।

এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি। আমাদের গন্তব্যস্থল রাজধানী শহর সারায়েভো থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে শিল্পনগরী জেনিচা। শহর ছাড়াতেই চোখে পড়ল পথের দুপাশে সবুজ প্রান্তর – পপলার, বার্চ আর ওকগাছগুলি সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে, মাঝে মাঝে দেখা যায় গ্রাম্য কুটির, ফুলের বাগান আর চোখে পড়ে আপেল, নাসপাতির বাগান আর স্ট্রবেরীর ঝোপ।কিছু দূর যাবার পর চোখে পড়ল শিল্পনগরীর বসতি,  গাড়ীটা বাঁক ঘুরতেই দেখা পেলাম নুড়ি বিছানো বসনা নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। 

#4 Bosna  River Zenica

গত বারের আর এবারের আসার মধ্যে এই  দীর্ঘ সময়ে অনেক জল বয়ে গেছে এই নদী দিয়ে  অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে। কিন্তু যা দেখছি তাতে শহরের বিরাট কোনও পরিবর্তন দেখলাম না। শুধু চোখে পড়ল না UN লেখা বড় বড় সাদা গাড়ী গুলি এবং হোটেলের লবিতে বা  অন্যত্র স্টেনগান হাতে ইটালিয়ান এবং তুর্কী সেনারা।

পরের দিন কর্মস্থলে গেলাম। পুরনো অনেকের সাথে দেখা এবং শুভেচ্ছা বিনিময় হলো।  গতবারে যে ছেলেটি আমাদের সাথে দোভাষীর কাজ করেছিলো সে ছিল ভালো ফুটবল প্লেয়ার। তার কাছে শুনেছিলাম গৃহযুদ্ধের সময় শহর যখন অবরূদ্ধ ছিল তখনকার অবর্ণনীয় কষ্টকর দিনযাপনের কাহিনী। বরফের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে দূর থেকে নিয়ে আসতে হত রিলিফের খাদ্য সামগ্রী। এবারে যে ছেলেটি আমার সাথে দোভাষীর কাজ করবে সে বয়সে তরুন এবং স্বভাবেও বেশ শান্ত। পরে ওর সম্বন্ধে আরো অনেক কিছু জানলাম – ও ভারতেও কিছু সময় ছিলো এক আশ্রমে। সেই প্রসঙ্গে পরে আসবো। প্ল্যান্টের মধ্যে কিছু অংশ যা গতবার দেখেছিলাম বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়ে গেছে তার কিছু ভগ্নাবশেষ এখনো বর্তমান – বাকীটা আর্ক ফার্নেসে স্ক্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার হয়ে গেছে। মেশিন শপ আর ফোর্জ শপ যা যুদ্ধের সময় এন্টি-এয়ারক্রাফ্ট গানের ব্যারেল  তৈরি করতে ব্যস্ত থাকত সেখানে আবার কারখানার  বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে আবার সবাই যে যার কাজে লেগে পড়েছে।

যে কোন দেশকে জানার সবচেয়ে ভালো উপায় সেখানকার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সেদেশটাকে দেখা, সেখানকার জনগণের সঙ্গে মিশে তাদের কথা জানা এবং তাদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্যক ভাবে পরিচিত হওয়া। এই উদ্দেশ্যে আমরা কাজের শেষে সপ্তাহান্তে বেড়িয়ে পড়তাম বিভিন্ন শহরে। কখনো রাজধানী সারায়েভো, কখনো মধ্য বসনিয়ার ত্রাভনিক বা দক্ষিণে মোস্তার।

1 Comment

  1. সুপ্রিয় ভৌমিক

    অনবদ্য .. খুব ভালো লাগলো.. শুধু মুগ্ধ হয়ে পড়লাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *